স্বদেশ ডেস্ক:
ইসরাইলের ভূখন্ডে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের নজিরবিহীন হামলার পর গত এক সপ্তাহ যাবত গাজায় তীব্র বোমা বর্ষণ করছে ইসরাইল। ইসরাইলি বাহিনীর বিমান হামলার গাজা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে।
হামাস-ইসরাইল সংঘাতে দু’পক্ষেই বহু বেসামরিক মানুষের হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে।
ইসরাইল এবং মধ্যপ্রাচ্যে একধরণের শান্তিপূর্ন অবস্থার মধ্যে হঠাৎ এই সংঘাতের পরিণতি কী? হামাস আসলে কী চায়? এই ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যে কী প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে?
হামাস কী চায়?
হামাস ইসরাইলে ঢুকে দেশটির সেনাবাহিনীকে পরাজিত করবে এমন সক্ষমতা তাদের নেই। আবার ইসরাইলের বিভিন্ন এলাকা দখল করে দিনের পর দিন সেটা ধরে রাখবে হামাসের পক্ষে সেটাও সম্ভব না। বাস্তবে সেটা হয়ওনি।
এমনকি ইসরাইলের বিমান হামলা মোকাবেলা করার ক্ষমতাও হামাসের নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হামাস তাহলে এতো সুচিন্তিতভাবে ইসরাইলে এমন একটি হামলা কেন করতে গেল?
এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা। প্রথমত, গত রমজানে আল-আকসা মসজিদে ইসরাইলের সামরিক অভিযানের প্রতিশোধ।
দ্বিতীয়ত, ইসরাইলের সেনাবাহিনী যে অজেয় নয়, সেটা প্রমাণ করা।
তবে হামাসের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ভিন্ন। মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো খালেদ এনগিন্দি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলছেন, হামাস মূলত: চায় ফিলিস্তিনের ইস্যুগুলোকে আবারো আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসতে।
তিনি বলেন, ‘গাজার পরিস্থিতি মাঝেমধ্যেই উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। রকেট হামলা হবে-এরপর হবে পাল্টা বিমান হামলা। কয়েকদিন পর আবার যুদ্ধ বন্ধ হবে। কিন্তু গাজাবাসীর বাস্তবতার পরিবর্তন হবে না। বছরের পর বছর ধরে এই যে একটা খেলা, হামাস সেটা বদলে দিতে চায়।’
’তারা চায়, গাজার চিরস্থায়ী অবরুদ্ধ দশার সমাধান হোক। এমন একটা উপায় বের করা হোক যেটা ইসরাইলের দখলদারিত্বের সমাপ্তি টানবে, নতুন বসতি স্থাপন বন্ধ করবে।’
একই মত দিচ্ছেন ইসরাইল ভিত্তিক থিংক ট্যাংক দ্য ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজ (আইএনএসএস) এর জ্যেষ্ঠ গবেষক ইয়োহানা জোরেফ।
তবে তার মতে, ফিলিস্তিন ইস্যুকে আবারো আলোচনায় আনার পাশাপাশি আরো দুটি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে চায় হামাস। সেটা হচ্ছে, জিম্মিদের ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে ইসরাইলের কারাগারে বন্দী হামাস নেতাদের মুক্ত করা এবং আল আকসা মসজিদে ইসরাইলের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা।
মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে কী প্রভাব?
হামাস যে উদ্দেশ্যেই ইসরাইলে হামলা করুক না কেন, সেটা কতটা পূরণ হবে তা নিশ্চিত নয়। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত, সেটা হচ্ছে, হামাস-ইসরাইল সংঘাত সাম্প্রতিককালে মধ্যপ্রাচ্যে গড়ে ওঠা নতুন ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বদলে দেবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরাইল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি করেছে, যেখানে আরব দেশগুলোর অনেকেই ইসরাইলের সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরিতে মনযোগ দিয়েছে এবং ফিলিস্তিন ইস্যুকে বাইরে রেখে একান্তই নিজেদের ইস্যু নিয়ে এগোতে চেয়েছে।
তুরস্ক, মিশরের পর আব্রাহাম অ্যাকর্ডের মাধ্যমে ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করেছে বাহরাইন, সংযুক্ত আরব-আমিরাত মরক্কোর মতো দেশগুলো। এখন সেটাই ভাটা পড়বে।
তুরস্কের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক মুরাত আসলান বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখা হামাসের জন্য ছিলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এখন যে পরিস্থিতি তাতে বেশি লাভ হবে ইরানের।
‘এখানে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে ইরান। কারণ, ইসরাইল ইরানকে পাশ কাটিয়ে তুরস্ক, মিশর, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে এনেছিলো। কিন্তু এখন এটা হোঁচট খাবে। কারণ, ইসরাইল গাজায় যতো বেশি হামলা করবে, আরব দেশগুলোর জনমনে ততবেশি ক্ষোভ তৈরি হবে। ফলে সেসব দেশের জন্য ইসরাইলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক এগিয়ে নেয়া কঠিন হবে। ইরান সেটাই চায়।” বিবিসিকে বলছিলেন মুরাত আসলান।
সৌদি-ইসরাইল চুক্তির কী হবে?
এখন সেটা প্রায় অসম্ভব বলেই মত দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। মুরাত আসলান বলছেন, আরব জনমত ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ।
ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া যতো নিষ্ঠুর হবে, জনমনে ততো ক্ষোভ তৈরি হবে। ফলে এর মধ্যে সৌদি আরবের পক্ষে শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়।
অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগী এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস এর সিনিয়র ফেলো অ্যারন ডেভিড মিলারও বলছেন একই কথা।
‘দেখুন, হামাস এমন একটা অবস্থা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে যেখানে ইসরাইল-সৌদ শান্তিচুক্তি এখন প্রায় অসম্ভব,’ বলেন মি. কার্নেগী।
’মার্কিন মধ্যস্থতায় যে ইসরাইল-সৌদি শান্তি আলোচনার উদ্যোগ ছিল, সেখানে ইসরাইল কিংবা মোহাম্মদ বিন সালমান কেউই ফিলিস্তিনীদের দাবিকে সামনে আনেনি। এখন সেই চুক্তি অসম্ভব।”
সৌদি আরব ইতোমধ্যেই ফিলিস্তিনীদের ‘ন্যায্য অধিকার’ এবং ফিলিস্তিনে ‘স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায়’ ফিলিস্তিনী জনগনের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক আটলান্টিক কাউন্সিলের সিনিয়র ফেলো ক্রিস্টেন ফন্টেনরোজ অবশ্য বলছেন, সৌদি আরব-ইসরাইল সম্ভাব্য শান্তিচুক্তির সম্ভাবনা এখনো আছে।
তার মতে, ইসরাইলকে এখন সতর্ক এবং দায়িত্বশীল হতে হবে যেন তাদের সামরিক জবাবে নিরীহ ফিলিস্তিনীদের নির্বিচারে মৃত্যু না ঘটে। সেটা হলে সৌদি আরবের পক্ষে এই হতাহতের ঘটনা এড়িয়ে চুক্তি করা অসম্ভব হয়ে যাবে।
তবে এতোকিছুর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি পরিবর্তন ঘটে গেছে। সেটা হচ্ছে, ঐ অঞ্চল থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে একরকম গুটিয়ে নেয়া আমেরিকা আবারো নিজের উপস্থিতি জোরদার করেছে।
সবকিছু মিলিয়ে হামাসের হামলা মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিকে আবারো উত্তপ্ত করে তুলেছে। কিন্তু এখান থেকে বাস্তবে হামাস নিজেদের জন্য কতটা সুবিধা আদায় করতে পারবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
সূত্র : বিবিসি