দাদি বা নানির কাছে নাতি হলো বংশের বাতি। তাই এ স্নেহভাজনের প্রতি তাঁদের বাড়তি একটা টান থাকে। একজন নানি চাইবেন তাঁর নাতি পড়াশোনা করে শিক্ষিত হোক, সমাজের বুকে সম্মানজনক জায়গা করে নিক। এটাই স্বাভাবিক। এতে লক্ষ্য মূলত একটাই, বংশের বাতি ভবিষ্যতে রোশনাই ছড়াবে। কিন্তু পড়ার কথা বলায় নাতি যে নানির জীবনের বাতিই নিভিয়ে দেবে, তা কে জানত?
রোববার প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে এই ‘গুণধর’ নাতির খবর প্রকাশিত হয়। ‘নানি খুন-মামা আহত, কিশোর গ্রেপ্তার’ শীর্ষক খবরে উল্লেখ করা হয়, কিশোর ওই নাতি (১৪) নানির কাছেই থাকত। পড়াশোনা করত না। এতে প্রায়ই বকাঝকা করতেন নানি। শনিবার সকালে বকুনি দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওই নাতি উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নানিকে খুন করেছে। লাশ লুকিয়ে ফেলার সময় মামা এসে দেখে ফেলায় তাকেও ছুরিকাঘাত করে ওই কিশোর। এতে মামা আহত হয়েছেন।
কিশোরগঞ্জ সদরে ঘটা এ হত্যাকাণ্ড একটি অতি অস্বাভাবিক ঘটনা। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে হালে এক ধরনের কিশোর-যুবার দেখা মেলে। যা ঘটেছে, এর বিপরীত বা স্বাভাবিক ঘটনা কি হতে পারত, এই নবীনেরা শুধু নিজেরাই উজ্জ্বল হবে না, তারা বড়দের অসংগতি ধরিয়ে দিয়ে তাঁদের চোখ খুলে দেবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতায় আধমরা বড়দের ঘা মেরে বাঁচাতে নবীনদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আদর করে বলেছেন ‘ওরে আমার কাঁচা’। কিন্তু সেই কাঁচায় ঘুণ ধরলে পাকাদের আর বাঁচাবে কে?
কাঁচায় ঘুণ ধরার নানা আয়োজন চারপাশে। হাতের নাগালেই। একটা হলো কিশোর গ্যাং। কিছু কিশোর মিলে একটা গ্রুপ করে ফেলে। চটকদার নাম হয় সে গ্রুপের। শুরুতে থাকে কিশোরসুলভ দম্ভ আর শক্তি জাহিরের ভাব। তারপর তারা অবৈধ অস্ত্র বহন ও মাদকদ্রব্য সেবনের মতো গুরুতর অপরাধে জড়ায়। গ্রুপে গ্রুপে চলে সংঘাত। এতে খুনখারাবির মতো ভয়ংকর ঘটনাও ঘটছে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা হচ্ছে বিপন্ন। এভাবে সাড়ে সর্বনাশের পথে পা বাড়াচ্ছে তারা।
আর কিশোর গ্যাংয়ে যদি চট্টগ্রামের টিনুর মতো একজন ‘বড় ভাই’ থাকে, তবেই হয়েছে! অপরাধ কত প্রকার ও কী কী, ভালোই মকশো করতে পারবে তারা।
বর্তমানে সমাজের সব কয়টি স্তরেই গড়পড়তা কিশোরের আচরণগত পরিবর্তন ঘটেছে। এর কারণও আছে। বিশ্বায়নের অবারিত দ্বারের সুযোগে ভিনদেশি সংস্কৃতি অবাধে ঢুকে পড়ছে দেশে। এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি দিকই আছে। তবে নেতিবাচক দিকটাই প্রভাব ফেলছে বেশি। যেমন পাশ্চাত্যের শিক্ষার চেয়ে তাদের এক ধরনের উগ্র চালচলন কিশোর-যুবাকে আকৃষ্ট করে থাকে।
প্রযুক্তিগত উৎকর্ষে জীবনের অনেক যান্ত্রিক অনুষঙ্গ এখন সহজলভ্য। নেট সংযোগ থাকা একটা স্মার্টফোন পেলে আর কিছু লাগে? অনেক কিশোরেরই পরম আরাধ্য এটি। গ্রাম থেকে আসা কোনো কিশোর শহরে রেস্তোরাঁ বা অন্য কোথাও গায়ে-গতরে খেটে কিছু টাকা জমাতে পারলে প্রথমেই স্মার্টফোন কিনে ফেলবে। তারপর ফেসবুক খুলে চলে যাবে অন্য দুনিয়ায়। দেখবে যৌনতায় ভরা ভিডিও। তখন কি আর সে তেরো-চৌদ্দ বছরের সেই বিভ্রান্ত কিশোর? ‘এক থা টাইগার’ দাপাচ্ছে তার বুকে। এ সময় বড়রা একটা কিছু বললেই হয়েছে। সেও একহাত দেখাবে।
ভদ্র ঘরের কিশোরের কথায় আসুন। তারও যে স্মার্টফোন চাই। এসব না হলে আজকাল চলে? অমুক বন্ধু একটা ভিডিওর কথা বলেছে। সব ফাঁস! স্মার্টফোনের জন্য রাতে তার ঘুম হয় না। বাবা যদি কঠিন হন, তবে মা ভরসা। মা কঠিন হলে বাবা। ঘ্যানঘ্যান করে আদায় করবেই। কতক্ষণ আর ‘না’ করা যায়? মা-বাবা কেউ রাজি না হলে অন্য ব্যবস্থাও আছে। টাকা জমিয়ে গোপনে কেনা। আর এই ছোট্ট যন্ত্রটা লুকিয়ে রাখা কোনো বিষয়? এসব কিশোর ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে হাবুডুবু খায়। কারও কারও ফেসবুক আইডি থাকে ভুয়া। দেখা যায়, সমবয়সী ভেবে বয়সে বড় কোনো তরুণীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে। এ ধরনের কেলেঙ্কারি তো আছেই, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে নিজের। সেটা পড়াশোনার ১২টা বাজানো।
এসব কিশোর অনেকে এক ধরনের হিরোইজমের ঘোরে থাকে। কেউ কেউ প্রকাশ্যে সিগারেট ফোঁকে। একটা সময় ছিল, যখন কিশোর সিগারেটে অভ্যস্ত হওয়ার সময় আড়ালে অনেক কসরত করে কাজটা সারত। একবার ফুঁকে দশবার মুখ ধুয়ে সুগন্ধী চকলেট মুখে পুরে তবেই বড়দের সামনে আসত। এখন তারা পাড়ার মোড়ে সিগারেট ফোঁকে, বড়রাই বরং না দেখার ভান করে তাদের পাশ কাটান।
এখন বই পড়ার চল নেই। একদিন কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে এক ছেলের ধারণা দেখে একটু অবাকই হলাম। সে অবলীলায় বলল, ‘উনি তো বিদ্রোহী’। এই বিদ্রোহী বলতে কী বোঝাতে চেয়েছে, তা সে-ই জানে। আমি আর জিজ্ঞেস করিনি। বই না পড়লে তারা রবীন্দ্রনাথ-নজরুল সম্পর্কে জানবে কীভাবে?
তবে কবিতা বা গল্পের বই পড়ার সময় নেই তাদের। কারণ ঘুম থেকে সকালে উঠেই তো সেই মোবাইল-ফেসবুক। স্কুলে যাওয়া-আসার বাইরে যে সময়টুকু মেলে, সেখানেও তো ওই ফেসবুকই চলে। এই ভার্চ্যুয়াল ‘বুক’ পড়লে কাগুজে বই পড়ার সময় কোথায়?
কিশোরযুবা কারও কারও ধারণা, কবিতা-গল্প-উপন্যাস পড়ে কী হবে? অযথা সময় নষ্ট। এর চেয়ে বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিবিষয়ক বই পড়া ভালো। অপ্রিয় হলেও সত্যি যে বড়দের মধ্যে কিছু লোকও এ ধারণা পোষণ করেন।
কিন্তু একটা মধুর কবিতা, একটা ভালো গল্প মানুষের মনকে যে আর্দ্র করে, তাকে ভাবালুতায় আচ্ছন্ন করে, মায়া-মমতাকে পলিশ করে, এটা কে বোঝাবে? গল্প-উপন্যাস-কবিতা মানুষের কল্পনাশক্তি বাড়ায়। জুলভার্নের বইয়ে চন্দ্রাভিযানের কল্পকাহিনি পড়েই মানুষ চাঁদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল।
বই মানুষকে বদ চিন্তা থেকে দূরে রাখে। ভালো-মন্দ বোঝার বিবেকবোধ জাগ্রত করে। মানুষের মনে সুকুমার প্রবৃত্তির উদ্ভব ঘটায়, যা মানুষের অপরাধপ্রবণতা ঠেকায়। কিশোরগঞ্জের সেই কিশোরটির নিত্যসঙ্গী বই হলে সে কি পারত তার নানিকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করতে?
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: