মমতাজ বেগম:
ফিরোজ এখন দেয়ালের ছবি। ও আমার মেজো ভাই। খুব মেধাবী ছিলো। পড়াশুনা করতো বিএম কলেজে। তখন উত্তাল পূর্ব-বাংলা। জাতীয়তাবাদীরাতো বটেই, কমিউনিষ্টদের শক্তিশালী অংশগুলোও স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রাখছে। ও সবসময় সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী পড়তো। কোন সময়ে ওর কোন আব্দার ছিলোনা, থাকতোনা। তবে চকচকে কিবা সস্তা হোক কিংবা দামী হোক বাহারী জুতার প্রতি ওর একটা দূর্বলতা ছিলো। আমরা ভাইবোনরা হাসাহাসি করতাম। ও গম্ভীর হয়ে বলতো খালি পা’তো মাটি পায়না দ্যাখে মিউনিসিপ্যালটির রাস্তা আমি এই জুতার মধ্যে বেশ আছি..
১৯৭১ সালের শুরু। যুদ্ধ তখনও শুরু হয়নি। ক্ষমতায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান। পূর্ব-বাংলার ঈশান কোনে মেঘ। আমার বাসা তখন বরিশাল শহরের বৈদ্যপাড়ায়। কৌশলগত কারনে ভাড়াটিয়া হিসাবে পরিবার নিয়ে থাকছি। ফিরোজ কয়েক মাস ধরে উধাও। কাউকে কিছু বলছি না। চুপচাপ থাকছি। ও গুপ্ত সংগঠনে যোগ দিয়েছে। পার্টির নির্দেশে যুদ্ধ প্রস্তুতি হিসাবে বাসা ছেড়েছে। একদিন সন্ধ্যাবেলা, রান্নার কাজে রান্নাঘরের বাইরে তরকারীর খোসা, মাছের আঁশ ফেলতে গিয়ে দেখি বেড়ে ওঠা জাম গাছটির গোড়ায় একটা আবছা ছায়ামূর্তি। আমি কণ্ঠ চড়াবার মূহুর্তে ছায়ামূর্তি জলদি পা চালিয়ে সামনে আসলো। বললো, আস্তে ছোট্টবুয়া আমি ফিরোজ। হাসতে যেয়ে চোখ থেকে পানি বের হলো। কোন রকমে বললাম, ভেতরে আয় ভাত খেয়ে তারপর ঘুমাবি, সকালে বাবার সাথে দেখা করবি। না ছোট্টবুয়া, মাথা এপাশ ওপাশ করে ও । আমি চোখ পাকাতেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, সাথে পার্টির লোক আছে। ভালোভাবে আশপাশ তাকালাম এবং নিশ্চিত হলাম ও একা না, সামান্য ব্যবধানে রাস্তার মোড়ের দিকে সতর্ক একজন, অপরজন ফিরোজকে বাচিঁয়ে একটু দুরে রান্নাঘর আর মুল ঘরের মাঝামাঝি। আমার দীর্ঘশ্বাসটা ছিলো সশব্দের। বললো, আগামীকাল সীমান্ত পাড়ি দেবো, যেন কতদুর থেকে বলছে ও, যেন দিগন্তের ওপাড় থেকে। কবে কোথায় আসবো, থাকবো জানি না। পার্টি জানে। ভালো থাকবা ছোট্টবুয়া। আচমকা ঝুকে অন্ধকারে আমাকে সালাম করে ও যখন পার্টি গেরিলাদের সাথে চলে যায় তখন সন্ধ্যা গড়ালো রাতের দিকে। অন্ধকারে আমি ভাইটার মুখটাও ভালোভাবে দেখতে পাইনি। মাঝে মাঝে ওর বন্ধু-বান্ধব দু’একজনের সাথে হঠাৎ সামান্য সময়ের সাথে দেখা হয়, ওদের মাধ্যমে এলামেলোভাবে জানতে পারি, ফিরোজ শত্রুপক্ষের বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করে স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গুপ্ত সংগঠনগুলোকে সরবরাহ করে।
সাকরাইল গ্রামের রাজাকার এবং বরিশাল শহরের শান্তি কমিটির নেতা মতিউর রহমান। এ দু’জন ভিন্ন ভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া পরিবার/ সদস্যদের ব্যাপারে খোজ খবর নিয়ে রাজাকার ক্যাম্প কিংবা হানাদার ক্যাম্পে সংবাদ পৌছাতে থাকে। বেতনÑভাতা, রেশন সুবিধা, লুটপাটের জন্য বিশেষতঃ অনেক তরুন-যুবা তখন রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীতে নাম লেখাতো। আল্ শামস বাহিনী খুব সম্ভব নিয়ন্ত্রন করতো নেজামে ইসলাম। ঐ দলটির চেয়ে জামাত ইসলাম ছিলো অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী। যার দরুন জামায়েতের আলবদর বাহিনী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছিলো সংগঠিত/ শক্তিশালী। শান্তি কমিটি শান্তি রক্ষ্মার নামে মূলতঃ স্বাধীনতাবিরোধী এক শ্রেনীর সুবিধাভোগী লুটপাটকারীদের দখলে চলে যায়। যাই হোক, ফিরোজ খুব গোপনে সাকরাইল আসে। ও আসে ভরিপাশা গ্রাম থেকে। অঞ্চলটা অনেক দূর্গম চরাঞ্চলের দিকে। দক্ষিনের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে শত্রুর সংবাদ সংগ্রহ করে, মুক্তিযোদ্ধদের সম্পর্কে একটা সম্যক ধারনা লাভ করে ফিরোজ। রাজাকার আলবদররা মনে করে ফিরোজ বর্ডার ক্রশ করে ভারতে গেছে। কিন্তু দূর্ভাগ্য, সাকরাইলে ওর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয় ধুরন্ধর রাজাকার ছাত্তার খান। নিকটস্থ পাকিস্থানী আর্মি ক্যাম্পে এই মর্মে সংবাদ পৌছায় যে, খুব দ্রুত ফোর্স নিয়ে চলে আসুন, মুক্তিদের প্রথম সারির গুপ্তচর ফিরোজ কবির এখন সাকরাইল অবস্থান করছে। খেয়া পাড়ি দিলে ওকে আর ধরা যাবে না। মূহুর্তে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক ক্যাপ্টেন কিছু সৈন্য আর স্থানীয় রাজাকার নিয়ে ফিরোজকে গ্রেপ্তার করে। তবে অন্য একটি সূত্র দাবী করছে, ছাত্তার খান নিজেই জনাকয়েক সশস্ত্র রাজাকার নিয়ে ফিরোজের অবস্থান ঘেরাও করে। যাই হোক, আর একটু সময় পেলে ফিরোজ নদী পাড় হয়ে দপদপিয়া অঞ্চল কিংবা গগন যেতে পারতো। গগন থেকে আটঘর, কুরিয়ানা, পেয়ারাবাগান তুলনামূলক কাছেই। চোখ হাত বেধে ফিরোজকে বরিশাল শহরের ত্রিশ গোডাউন এলাকায় আনা হয়। পাশেই নদী কীর্তনখোলা। বাকঁ নিয়ে আরো দুরে গিয়ে ধানসিঁড়ি, সুগন্ধা ইত্যাদী নদীতে গিয়ে মিশেছে। সেখানে ঝালকাঠী জেলা। ত্রিশ গোডাউন ছিলো হানাদারদের বাঙ্কার সমৃদ্ধ ক্যাম্প, টর্চার সেল। সে রাতেই নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করা হয় ফিরোজকে। ওর লাশ পাওয়া যায়নি। যে রাতে ফিরোজকে মারা হবে সেই বিকেলে বাবা শান্তি কমিটির নেতা মতিউর রহমানকে কিছু অনুরোধ করে, কিন্তু সে অনুরোধ অগ্রাহ্য করে। এমনকি মুক্তি বাহিনী. মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে কটুক্তি করে। ত্রিশ গোডাউন এলাকায় যেয়ে ক্যাম্প কমান্ডারকে বলে, এ জাইত সাপ, রাখলে মুশকিল, রাইতের মধ্যে খতম হওয়া জরুরী। আপনাগো সব খবর অয় মুক্তিগো জানায়া দেয়। ফিরোজকে ইন্টারোগেশনের চেষ্টা করেছিলো মিলিটারীরা। কিন্তু প্রতিবারই ফিরোজের একই উত্তর, আমি ইন্ডিয়ার উদ্বাস্তু, বিহার-উড়িষ্যার সীমান্তে আমার বাড়ি, যাদবরা হামলা চালালে এই অঞ্চলে আসি। অর্থাৎ ফিরোজ ভাবলো, আমিতো নিশ্চিত মারা যাবোই, আমার কোন তথ্য দ্বারা আমার পরিবার বা মুক্তি বাহিনীর যাতে কোনরুপ ক্ষতি না হয়।
ফিরোজ শহীদ হবার সংবাদ দক্ষিনের প্রায় সবগুলো মুক্তিঘাঁটিতে পৌছুলে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের চোখে। আটঘর থেকে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির একটি শক্তিশালী নিগেদ( নিয়মিত গেরিলা দল) সাকরাইল গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়, আশপাশের ন্যাপ, সিপিবি, আওয়ামীপন্থী মুক্তিযোদ্ধারা পার্টির নিগেদ কমান্ডারকে জানায় তারা যোদ্ধা, অস্ত্র এবং নিরাপদ রিট্টিট করার জন্য সব ধরনের সাহায্য করতে প্রস্তুত। পার্টি নিগেদ ভোর রাতে সাকরাইল প্রবেশ করে। গ্রাম তখন ঘুমে। থেকে থেকে রাজাকার ক্যাম্পগুলোতে আলো জ্বলে, রাত জেগে ষড়যন্ত্র হয়, লুটের ভাগাভাগি হয়। প্রকাশ্যে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয় পার্টি নিগেদ। তাতে শত্রু ভয় খাবে। খুব দ্রুত হিট এন্ড রান পদ্ধতিতে। ছাত্তার খানকে ধরে এনে একটি বটগাছের সাথে বেধে ফেললো পার্টির গেরিলারা। তার সঙ্গীয় রাজাকাররা যখন জানতে পারে এরা সর্বহারা, তখন ভয়ে কেউ টু শব্দটিও করলোনা। কেউ কেউ তাৎক্ষনিক অস্ত্র জমা দিয়ে পার্টির সদস্য হতে চাইলো। হত্যার আয়োজনে সাকরাইল থেকে কেউ বা কোন কোন রাজাকার যাতে নিকটস্থ পাকিস্থানী ক্যাম্পে সংবাদ দিতে না পারে সেজন্য জল-স্থলের সব পথ সিলগারা করে দেয় পার্টি নিগেদ। এরপর নিগেদ কমান্ডার নিজেই বেয়নেট চার্জ করে। বাবা তখন গ্রামের বাড়িতে। এ সংবাদ পেয়ে তড়িঘড়ি ছুটে আসে ঘটনাস্থলে, নিগেদ কমান্ডারের বেয়নেট ধরা হাত চেপে ধরে বলে-দয়া করো বাবা, ওকে আটকে রাখো, ধরে নিযে যাও কিন্তু প্রানে মেরোনা।ওকে মারলে আমার ছেলেটা কি ফিরে আসবে? কিন্তু কমান্ডার খুব বিনয়ের সাথে বাবার হাতটা ছাড়িয়ে বললো, চাচাজান আপনি চোখ বন্ধ রাখুন তাইলে কিছু দেখতে হবেনা। আমরা আমাদের কাজ শেষ করি। যে কোন সময়ে মিলিটারী চলে আসবে। আপনারা বলবেন সর্বহারা পার্টি পুরো গ্রামকে বন্দুকের নলের সামনে রাখে, আমরা খান সাইবকে বাচাঁইবার
চেষ্টা করছিলাম। এক গেরিলা খুব দ্রুত বাবার চোখ গামছা দিয়ে বেঁধে দেয় যাতে হত্যা দৃম্য দেখতে না হয়। পার্টির ভাষায় ভাষায় খতম শেষ হলে নিগেদ কমান্ডার ঘোষনা করে, কেউ লাশ নামাবার চেষ্টা করলে তাকেও ছাত্তার খানের পরিনতি ভোগ করতে হবে।
যুদ্ধ শেষ, এবার ঘরে ফেরার পালা, কিন্তু সবাই কি ফিরবে? ফিরোজরাতা আর কোনদিন ফিরবে না। ওদের জীবিত সহযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে ফের বের হলো ক্যাম্প থেকে। অনেক হিসাব বাকী। কারো হিসাবে পূর্ববাংলার অসমাপ্ত জনগনতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হবে। কারো চোখে খুনের নেশা! যারা তাদের সহযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিয়েছে হানাদারদের কাছে তাদেরকে নির্মম পরিনতি ভোগ করতে হবে। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল শান্তি কমিটির নেতা মতিউর রহমানকে এনে শরীরে ডিনামাইট বেধে চার রাস্তার মোহনায় উড়িয়ে দেয়। প্রতিশোধের আর কোন বৃত্তান্তে গেলাম না। যুদ্ধ কেবল নির্মমতার জন্ম দেয়। হেলাল হাফিজের ভাষায় -‘যুদ্ধ মানে তোমার প্রতি আমার অবহেলা।’ অনেক যুদ্ধ করে নেপোলিয়ান বোনাপার্ট বলেছেনÑ যুদ্ধ বর্বরদের ভাষা। কিন্তু এ যুদ্ধ শুধু যুদ্ধ নয়, একটি জাতির অভ্যূদয়….
লেখক: সাবেক শিক্ষাবিদ ও কলামিষ্ট