স্বদেশ ডেস্ক:
সরকারি গেজেটে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোড ডি-ব্লকের পি/১ হোল্ডিংয়ের জমিটি পরিত্যক্ত ‘ক’ শ্রেণির। ১ দশমিক ৮০ কাঠার কোটি টাকা মূল্যের জমিটি কয়েক দশক ধরে বাড়ি ও দোকান বানিয়ে ভোগ দখল করে আসছেন এক যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। সম্প্রতি ক্রয়সূত্রে জমিটির মালিকানা দাবি করে সাইনবোর্ড তুলে দিয়েছে তানভীর হোল্ডিং লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এ নিয়ে সংঘর্ষের আশঙ্কায় তদন্ত কমিটি গঠন করে গণপূর্ত অধিদপ্তরের রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ।
রক্ষণাবেক্ষণ উপবিভাগ ২-এর উপবিভাগীয় প্রকৌশলীর নেতৃত্বাধীন এই কমিটি গত ৯ জুলাই প্রতিবেদন দাখিল করে। এতে বলা হয়েছে, জমিটির মালিক এখন পর্যন্ত সরকার। জমিটি জবরদখলে কারসাজির চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে ওই তদন্ত প্রতিবেদনে।
ওই তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে সাম্প্রতিক অগ্রগতি তুলে ধরে গত সোমবার ঢাকা বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের দপ্তরে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন গণপূর্ত রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মুস্তাফিজুর রহমান। এর আগে গত বৃহস্পতিবার তিনি গণপূর্ত রক্ষণাবেক্ষণ উপবিভাগ ২-এর উপবিভাগীয় প্রকৌশলীকে একটি চিঠি দেন। তাতে সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে থানায় সাধারণ ডায়েরি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। আদেশ পেয়ে সাধারণ ডায়েরির অভিযোগ থানায় জমা দেন উপসহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান। এরপর থেকে অব্যাহতভাবে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। পরে অবশ্য
অভিযোগটি গতকাল মঙ্গলবার জিডি হিসেবে রেকর্ডভুক্ত করেছে পুলিশ। জিডি নম্বর ১৩৩৯। তবে গতকাল দুপুরেও জমিটিতে তানভীর হোল্ডিং লিমিটেডের সাইনবোর্ড ঝুঁলতে দেখা গেছে।
প্রকৌশলী মিজানুর রহমান গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, ‘তদন্ত শুরুর পর থেকে অচেনা নম্বর থেকে আমাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তবে বিষয়টি কর্ণপাত করছি না। অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।’
জিডিতে বলা হয়েছে, বিভাগীয় প্রকৌশলী সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জমিটিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের দখলে ৫টি দোকান এবং ১টি আবাসিক অংশ রয়েছে। বাড়িটির সামনের দক্ষিণ পাশে তানতীর হোল্ডিং লিমিটেড নামে একটি সাইনবোর্ড টাঙানো। পরে গত রবিবার ফের তদন্তে গিয়ে দেখা যায় প্রতিষ্ঠানটি বাড়িটির সম্পূর্ণ অবকাঠামো ভেঙে খালি করে ফেলেছে।
জানা গেছে, ১ম কোর্ট অব সেটেলমেন্টে মামলা হলে ২০১০ সালের ২৬ মে সরকারের পক্ষে রায় প্রদান করেন আদালত। পরে বাড়িটির বিষয়ে ৫৮২১/২০১১ হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করা হলে আদালত ৩টি পর্যবেক্ষণ দিয়ে আদেশ দেন। ১ম কোর্ট অব সেটেলমেন্টে মামলা নম্বর ৪২৫/১৯৮৮-এর বিষয়ে ২০১৬ সালের ২৬ জুন সরকারের পক্ষে জমিটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে রায় প্রদান করেন আদালত।
যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন জানান, তাকে আজ অবধি কোনো পরিত্যক্ত বাড়ি কিংবা সরকারি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ১৯৮৭ সাল থেকে ওই বাড়িতে সপরিবারে বসবাস করছেন। রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা দিয়ে পরিবারের ভরণ-পোষণা করছেন। রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে বাড়ির দোকানগুলো এবং বাড়িটির সম্পূর্ণ অংশ প্রদান করলে সরকারি রাজস্ব প্রদান করবেন বলেও জানান ইসমাইল হোসেন।
জমিটি জবরদখলের অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করেছেন তানভীর হোল্ডিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমডি হাতেম আলী। তার দাবি, ওই জমিটি ১৯৬০ সালে সরকার প্রথম পক্ষের (এক ব্যক্তি) কাছে বিক্রি করে। প্রথম পক্ষ ১৯৭৪ সালে দ্বিতীয় পক্ষের (আরেক ব্যক্তি) কাছে জমিটি বিক্রি করে। দ্বিতীয় পক্ষের কাছ থেকে ২০২৩ সালে জমিটি কিনে নেয় তার প্রতিষ্ঠান।
নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মুস্তাফিজুর রহমানের দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জমিটিতে থাকা বাড়িটি একতলাবিশিষ্ট সেমিপাকা ইমারত। রাস্তাসংলগ্ন অংশে বাণিজ্যিক হিসেবে এবং পিছনের অংশ আবাসিক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। রাস্তাসংলগ্ন বাণিজ্যিক অংশে ৫টি দোকান রয়েছে। রহমানিয়া হোমিও হল হিসেবে ১ নম্বর দোকানটি পরিচালনা করেন এসএম আনোয়ারুল কাদির। দোকানটি প্রায় ৪০ বছর ধরে ভাড়াটিয়া হিসেবে তিনি ও তার পরিবার ব্যবহার করছেন। দখলের শুরু থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নাজমা বেগমকে তিনি নিয়মিত ভাড়া প্রদান করতেন।
২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মাসিক ভাড়া মো. ইসমাইল হোসেনকে প্রদান করেন। ভাড়াটিয়া হিসেবে ২ নম্বর দোকানটি এসকে কম্পিউটার টেকনোলজি নামে পরিচালনা করেন সাগর আহমেদ। সোহাগ ট্রেড সেন্টার নামে ব্যবহৃত ৩ নম্বর দোকানটি তদন্তকালে বন্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। সিয়াম জেনারেল স্টোর নামে ৪ নম্বর দোকানটি পরিচালনা করেন বিল্লাল হোসেন। নাদিম হোটেল নামে ৫নং দোকানটি পরিচালনা করেন মো. নাদিম। তারা প্রায় ২০ বছর ধরে দোকানের মাসিক ভাড়া প্রদান করেন ইসমাইল হোসেনকে। বাড়িটি বরাদ্দ পেতে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার ও পরিত্যক্ত ভূমি ব্যবস্থাপনা বোর্ড বরাবর আবেদন করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন।
জিডির তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার এসআই শাহরিয়ার আলম জানান, অভিযোগের তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।