যারা বাতিঘরের আলোতে দুনিয়ার সব জায়গাতেই আলো বিতরণ করতে চান তাদের উদ্দেশে আমার কিছু কথা। আমি অর্থনীতির ছাত্র নই। তবে খবরের কাগজের নিয়মিত পাঠক বা একজন ছোট লেখক হিসেবে নিজেকে ভাবতে পারি। আমি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী রাষ্ট্র কানাডাতে বসবাস করছি অনেক দিন ধরে। ২০০০ সালের ২১ জুন একটি পরিবেশবিষয়ক ফেলোশিপ নিয়ে কানাডা আসি। সেখান থেকে দিবস, সপ্তাহ, মাস গুণে গুণে এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম এদেশের আলো বাতাসের সাথে মিলেমিশে।
যখন কানাডা আসি তখন আমার সংসার খরচ ছিল। এখনো সেই খরচ অব্যহতভাবে চলছে। প্রতিদিনের বাজার, ঘর ভাড়া ও গাড়ির খরচ সবই ছিল অনেক কম। তখন এক কানাডিয়ান ডলার সমান ছিল বাংলাদেশের চৌত্রিশ থেকে ছত্রিশ টাকা। আর এখন এক কানাডিয়ান ডলারে বাংলাদেশের ৮২/৮৩ টাকা পাওয়া যায়। যারা এই উত্তর আমেরিকা থেকে ঢাকাতে নিয়মিত টাকা পাঠিয়ে থাকেন; তাদের বাংলাদেশের আত্মীয় স্বজন হয়তো এই টাকার বিনিময় বেড়ে গেছে বলে অনেকেই খুশি হন। কিন্তু যদি আমরা পণ্য বিনিময়ের বিগত দুই দশকের বছরের এই কানাডা আর ওই সুদূরের বাংলাদেশের বাজারের সওদা কিনতে দেখি, তখন কী দেখি। সেখানে দেখা যাচ্ছে টাকা তার পণ্য কেনার ব্যাপারে তার কেনার সামর্থ্য যেমন হারিয়েছে তেমনিভাবে কানাডা বা আমেরিকার ডলারও বিগত দুই দশকে তার পণ্য কেনার অনেক সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে।
এখানে যদি তর্কের খাতিরে বলা হয় যে বাংলাদেশ গরিব দেশ। লোকসংখ্যা আয়তনের তুলনায় বেশি। এদেশের রফতানি আয় কম। আর আমদানি খরচ অনেক বেশি। এর মূল কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দুর্নীতি বদনাম ইত্যাদি। তাই বাংলাদেশের পণ্য বা জায়গা জমি এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনের খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু কানাডা তো একটি বিশাল দেশ। আয়তনে বাংলাদেশের নিরানব্বই গুণ বড়। লোকসংখ্যা মাত্র সাড়ে তিন কোটি। কানাডার রফতানি আয় অনেক বেশি, আমদানি খরচের অনুপাতে। সেই কানাডার মধ্যে জীবনযাপন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। ঘর ভাড়া বেড়েছে। যে এপার্টমেন্টের ভাড়া ছিল টরন্টো মহানগরে সাত শত থেকে আট শত ডলার,সেই সাইজের বাসার জন্য এখন মাসিক ভাড়া দেয়া লাগে আঠার শ’ থেকে বাইশ শ’ ডলার।আর যে বাংলো টাইপের এক তলা বাড়ির দাম ছিল একুশ বছর আগে এই টরন্টো শহরে মাত্র এক লাখ সত্তর হাজার থেকে এক লাখ আশি হাজার ডলার, ওই আকারের একটি বাংলো বাড়ির চলতি বাজার মূল্য এখন নয় লাখ ডলার থেকে এক মিলিয়ন ডলার। আবার কোনো কোনো এলাকায় পনর লাখ পর্যন্ত দাম উঠেছে।অথচ কানাডার সরকার ধনী। এখানে অনেক ফসল ফলে। আমদানি খরচ কম। লোকসংখ্যা কম। তবুও দিনের পর দিন সব কিছুর দাম বেড়েছে গেছে। এর কারণ কী? কার একটাই দুনিয়ার ধনী-গরিব সব দেশের সরকারগুলো এখন বিশ্ব করপোরেট কোম্পানির পরোক্ষ বা সরাসরি কেনা গোলাম। এখন বিশ্বের বিভিন্ন তেজারতি, সেবা, চিকিৎসা, শিক্ষা বা যুদ্ধ সরবরাহের মালামাল এখন ওইসব করোপরেট গোষ্ঠীর অধীনে। কারণ আগে একটা দেশ ওই পরিমাণ কাগজের ফিয়াট নোট ছাপতে পারত বা বাজারে সরবরাহ করতে পারত সেই সমপরিমাণ সোনা (সলিড মজুত যা চব্বিশ ক্যারটের পিওর) থাকতে বাধ্য থাকত ওইসব দেশের কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ব্যাংকে। যার ফলে বাজারে ইচ্ছামতো ছাপানো নোটের সরবরাহ বাড়ানো যেত না।
কিন্তু ১৯৭০ সালের পর আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নিক্সন দুটি কাজ আদায় করে নেন বাদ বাকি দুনিয়া থেকে। ১.তারা সৌদি রাজার মাধ্যমে তেলের সংস্থা ওপেকের মধ্যে একটা আইন পাস করে যে বা যারা তেল কিনবে তাদেরকে অবশ্যই ডলার দিয়ে তেল কিনতে হবে। ২. ইউরোপের নেতারা আমেরিকাকে লিখিত অনুমতি দেয় যে এখন থেকে আমেরিকার মধ্যে বিশ্বের বাণিজ্যিক তহবিলের রিজার্ভ জমা থাকবে ডলার হিসেবে। আর আমেরিকা দরকার মনে করলে আগের আইন অনুযায়ী সমপরিমাণ খাঁটি সোনার রিজার্ভ না রেখে চাহিদা যোগানোর জন্যে কাগজের ফিয়াট ডলার ছাপতে পারবে।
মজার ব্যাপার হলো, সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের রিজার্ভ ব্যাংকগুলো সরকারিভাবে চলে। আর আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক বেসরকারি সংস্থা। এর মালিকানা রয়েছে ইহুদি রথচাইল্ড পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। এখানে কোনো পরিচালক বা পরিচালনা পরিষদ কেউ ঐ পরিবারের বাইরে থেকে হতে পারবে না।
চলতি বিশ্বের গতি দেখে মনে হচ্ছে আগামীতে খুব কম সময়ের মধ্যেই দেশে দেশে মানুষের কাছে হাজারো লাখ লাখ টাকা/রিয়াল/পাউন্ড /ডলার নগদ থাকবে। কিন্তু মানুষের কাছে তার চাহিদার মেটানোর জন্য পণ্য থাকবে না। তো এই অবস্থার মোকাবেলাতে আমরা যারা শোষকের হাতে দেশে দেশে শোষিত হচ্ছি, আমাদের কাজ হবে কাগজি নোট উপেক্ষা করা। সোনা, রুপা সাধ্যমতো যোগাড় করে রাখা। পণ্যের বিনিময়ে পণ্য বা সোনা রোপা র বিনিময় হার দিয়ে দেশে দেশে সাধ্যমতো বাণিজ্য চালু করা। সোনাই আসল ডলার। যা আরবি দিনার থেকে ডলার নামে দুনিয়ার দেশে দেশে মানুষের পকেট ভারী করছে। আমরা কি জানি, ইউরোপের কলোনিয়াল যুগ শুরুর আগে এক ইরাক সোনার দিনার ওই সময়ে ছিল ৪৭০ ডলার?
পরিশেষে বলতে চাই, দুনিয়ার গতি এমন ভাবে চলেছে যেকোনো সময়ে এই সব কাগজি নোটের আরো বেশি মূল্য পতন ঘটবেই ঘটবে। হোক সে আমেরিকার ডলার বা সস্তা রিয়াল। ছাপানো কাগজ তা ডলার, ইউরো, পাউন্ড, রিয়াল, টাকা কিংবা রুপি- যাইহোক এর দাম একই; আর তা হলো ছাপানো ফিয়াট। এককথায় বলা যায়, ছাপানো মুদ্রা শক্তিধর রাষ্ট্রের মাধ্যমে অসহায় রাষ্টগুলোকে দমিয়ে রাখার হাতিয়ার।
লেখক
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।
টরন্টো, কানাডা