স্বদেশ ডেস্ক:
আফ্রিকার দেশ মালি জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী আর রাখতে চায় না। দেশটির সরকার বলছে, জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর কারণে দেশটিতে শান্তি তো আসেইনি, উল্টো সমস্যা তৈরি করেছে। মালিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনার জন্য শান্তিরক্ষা বাহিনীকে দায়ী করছে দেশটির সরকার।
মালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী চলতি সপ্তাহের শুরুতে তার দেশ থেকে শান্তিরক্ষা বাহিনী অবিলম্বে প্রত্যাহারের জন্য জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে আহ্বান জানিয়েছেন।
মালিতে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর যে মিশন চলছে সেটি ‘মিনুসমা’ হিসেবে পরিচিত। জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনের তথ্য অনুযায়ী, মালিতে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর প্রায় ১৭০০ জন নিয়োজিত আছেন। এর মধ্যে সামরিক বাহিনীর প্রায় ১৪০০ জন এবং পুলিশ বাহিনীর প্রায় ৩০০ সদস্য নিয়োজিত আছে।
সামরিক বাহিনীর সদস্য মোতায়েনের ক্ষেত্রে আফ্রিকার দেশ শাদের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তৃতীয় অবস্থানে আছে মিসর।
‘মিনুসমার’ ১৩ হাজারের বেশি সৈন্য রয়েছে। এক দশক ধরে তারা তাদের মিশন পরিচালনা করে আসলেও দেশটিতে চলমান জিহাদি সহিংসতার বিস্তার বন্ধে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
রাশিয়ান ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপ এখন মালির সামরিক শাসকদের সহায়তা করছে পশ্চিমা কর্মকর্তারা ওয়াগনারের বিরুদ্ধে ইউক্রেন এবং আফ্রিকার কিছু অংশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে।
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র ইভান মাসলভের ওপর নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা করে। ইভান মাসলভ মালিতে নিযুক্ত ওয়াগনারের শীর্ষ কর্মকর্তা বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ওয়াগনার গ্রুপ পশ্চিমা অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। মালি এবং আফ্রিকার অন্যান্য অংশে তাদের কার্যক্রমের বিষয়েও তারা গোপনীয়তায় রক্ষা করে চলছে।
মালিতে ফ্রান্সের বহু বছরের সম্পৃক্ততার বিষয়ে মালির নাগরিকদের আপত্তির পরে এবার ‘মিনুসমার’ বিষয়ে সমালোচনা করছে দেশটির সরকার। সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্সের সাথে মালির জোট গত বছর ভেঙে যায়।
মালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডিওপ “মালিয়ান কর্তৃপক্ষ এবং মিনুসমার মধ্যে আস্থার সঙ্কট” নিয়ে কথা বলেছেন এবং বলেছেন “মালিয়ান সরকার অনতিবিলম্বে মিনুসমাকে প্রত্যাহার করতে বলেছে”।
‘মিনুসমার’ ম্যান্ডেট আগামী ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা, কিন্তু এই সময়ে নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাদের ব্যর্থতার বিষয়ে এখনো কোনো জবাব দিতে পারেনি।
৩০শে জুন ‘মিনুসমার’ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সেটির ম্যান্ডেট নবায়নের জন্য নিরাপত্তা পরিষদে ভোটাভুটি হবার কথা রয়েছে।
একটি রেজ্যুলিউশনের পক্ষে অন্তত নয়টি ভোট প্রয়োজন এবং এই রেজ্যুলুশন পাস করাতে পাঁচটি স্থায়ী প্রতিনিধি- রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ফ্রান্সের পক্ষ থেকে কোনো ভেটো পড়া যাবে না।
তবে জাতিসঙ্ঘের প্রধান অ্যান্টনিও গুতেরেস সুপারিশ করেছেন যে, মিশনটিকে এমনভাবে সাজাতে হবে যেন এটি সীমিত কয়েকটি বিষয় নিয়ে কাজ করে।
মালিতে জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূত এল-ঘাসিম ওয়ানে শুক্রবার ডিওপের মন্তব্য সম্পর্কে বলেছেন, “নিরাপত্তা পরিষদ যে সিদ্ধান্ত নেবে আমরা সেটাই মেনে চলবো”।
তবে তিনি যোগ করেছেন যে আয়োজক দেশের সম্মতি ছাড়া একটি নির্দিষ্ট দেশে কাজ করা অসম্ভব না হলেও, অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হবে”।
মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসঙ্ঘের হাইকমিশনারের একটি প্রতিবেদনে, গত বছরের মার্চ মাসে মধ্য মালির মৌরা গ্রামে অভিযানের চালানোর সময় ৫০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করার জন্য মালিয়ান সশস্ত্র বাহিনী এবং “বিদেশী নিরাপত্তা কর্মীদের” অভিযুক্ত করা হয়। মালি এবং রাশিয়া উভয় সরকারই এই প্রতিবেদনের নিন্দা করেছে।
আমেরিকার অবস্থান
মালির অন্তর্বর্তীকালীন সামরিক সরকার জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীকে দেশ ছেড়ে সরিয়ে নিতে বলার জন্য যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে দুঃখ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সোমবার আহ্বান জানায়, দেশটি থেকে যেন “সুশৃঙ্খল এবং দায়িত্বশীল” উপায়ে মিশন কমিয়ে আনা হয়।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, “মিনুসমার সংখ্যা কমিয়ে আনা অবশ্যই সুশৃঙ্খল এবং দায়িত্বশীল উপায়ে হতে হবে। যেন শান্তিরক্ষী এবং মালিয়ানদের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেয়া যায়।”
পররাষ্ট্র দফতর থেকে আরো বলা হয় যে সামরিক নেতৃত্বাধীন মালিয়ান সরকারকে “তার সমস্ত প্রতিশ্রুতি মেনে চলতে হবে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের মার্চের মধ্যে একটি নির্বাচিত বেসামরিক প্রশাসনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।
মিলার এক বিবৃতিতে বলেছেন, “এই সিদ্ধান্তের ফলে মালিয়ান জনগণের নিরাপত্তা ও মানবিক সংকটের ওপর যে প্রভাব পড়বে তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।”
ইসলামপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠীর তৎপরতা রুখতে মালির সরকার লড়াই করছে, যা ২০১২ সালে একটি অভ্যুত্থানের পর শেকড় গেড়েছিল।
পরের বছর ২০১৩ সালে দেশটিতে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ। এর লক্ষ্য ছিল স্থিতিশীলতা ফেরাতে সেখানকার বিদেশী এবং স্থানীয় প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।
নিরাপত্তাহীনতা ক্রমেই বাড়ত থাকায় ২০২০ এবং ২০২১ সালে দুটি অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে এবং সেনা শাসক শান্তিরক্ষী বাহিনী এবং ফ্রান্সসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক মিত্রদের সাথে বিরোধে লিপ্ত হয়।
দেশটির সামরিক বাহিনী সেখানকার মিত্রদের সাথে মিলে সেতু পুড়িয়ে দিয়েছে এবং তার সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য রাশিয়ার সহায়তা নিয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম আফ্রিকায় আমাদের অংশীদারদের সাথে কাজ করা চালিয়ে যাবে যাতে তারা জরুরি নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহায়তা করতে পারে। স্থিতিশীলতা উন্নীত করতে এবং সংঘাত প্রতিরোধে অতিরিক্ত পদক্ষেপের বিষয়ে আঞ্চলিক নেতাদের সাথে আলোচনাকে আমরা স্বাগত জানাই।”
বুরকিনা ফাসোর সামরিক সরকার মালির “সার্বভৌমত্ব এবং তাদের নিজেদের ভাগ্য নিজেদের গড়ার” সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।
দেশটির সরকারের মুখপাত্র রিমতালবা জিন ইমানুয়েল ওয়েড্রোগোকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা এএফপি বলেছে যে এটি একটি “সাহসী সিদ্ধান্ত।”
এই বছরের শুরুর দিকে, বুরকিনা ফাসো একটি ছোট ফরাসি বাহিনীকে তার সীমান্ত ছেড়ে যেতে বলেছে।
সূত্র : বিবিসি