স্বাধীনতার পর যখন ব্যাংকগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়, তখন বলা হয়েছিল এর মালিক হবে জনগণ। এর লভ্যাংশ ও সেবা দুটোই জনগণ পাবে। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেল, জনগণ নয়, একশ্রেণির কর্মকর্তা ও ট্রেড ইউনিয়নের নেতা লাভের গুড় পুরোটাই হজম করেছেন। একসময় দেখা গেল, স্বৈরাচারী সরকারগুলো ক্ষমতায় থাকার জন্য ব্যাংকের সিবিএকে ব্যবহার করত। এখন সরকারি ব্যাংকে ট্রেড ইউনিয়নের দৌরাত্ম্য অনেকটা কমেছে। কিন্তু বেড়ে গেছে ‘দেশপ্রেমিক’ শিল্পোদ্যোক্তাদের লুটপাট। তাঁরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আর সেটি ফেরত দেন না। ফলে খেলাপি ঋণের চাপে মুমূর্ষু সরকারি ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে জনগণের করের অর্থে মূলধন জুগিয়ে। গত বাজেট পর্যন্ত এই ধারা চলছিল। শোনা যাচ্ছে, এবারেও তাঁরা ভর্তুকি পাচ্ছেন।
কয়েক দিন আগে প্রথম আলোর খবরে বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালীর মুনাফায় বড় ধরনের ধস নেমেছে। ২০১৮ সালে ব্যাংক চারটির সম্মিলিত নিট মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৯২ কোটি টাকা, যা আগের বছরের চার ভাগের এক ভাগ। মুনাফা কমে যাওয়ার কারণ, ব্যাংকগুলোতে বড় গ্রাহকদের অনেকে খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করেও কিস্তি পরিশোধ করছেন না। ফলে খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে আয় থেকে বিপুল অর্থ সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। এ ছাড়া এ চার ব্যাংক গ্রাহকদের যে ঋণপত্র, নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টির মতো ‘নন ফান্ডেড’ (নগদ টাকার বাইরে দেওয়ার নিশ্চয়তা) সুবিধা দিয়েছিল, তার একাংশও খেলাপি হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে সোনালী ব্যাংকের নিট মুনাফা ছিল ৭০৯ কোটি টাকা, যা ২০১৮ সালে দাঁড়িয়েছে ২২৬ কোটি টাকায়। একইভাবে জনতা ব্যাংকের নিট মুনাফা ২৬৮ কোটি টাকা থেকে কমে হয়েছে ২৫ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের মুনাফায়ও বড় ধস নেমেছে। ২০১৭ সালের ৬৭৬ কোটি টাকার মুনাফা থেকে গত বছর তা কমে ১০৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অবশ্য বাকি ব্যাংকগুলোর তুলনায় রূপালীর মুনাফা কম হারে কমেছে, ৫০ কোটি টাকা থেকে নেমেছে ৩৮ কোটি টাকায়। এ মুনাফা দেখাতেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে সঞ্চিতি রাখার ক্ষেত্রে ছাড় নিয়েছে ব্যাংকগুলো।
২.
সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ যেমন বাড়ছে, তেমনি কমছে সেবার মান। সাধারণ সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগ, বেসরকারি ব্যাংকে যে কাজ করতে ১০ মিনিট লাগে, সরকারি ব্যাংকে লাগে ৬০ মিনিট কিংবা তারও বেশি। ফলে গ্রাহকেরা বেসরকারি ব্যাংকের দিকে ঝুঁকছেন। মানুষ মনে করে, সরকারি ব্যাংকে হিসাব খোলা মানে বিড়ম্বনা। সরকারি ব্যাংকে কর্মকর্তাদের ঠিকমতো পাওয়া যায় না। এ কারণে বেসরকারি ব্যাংকে সেবার চার্জ বা খরচ বেশি হওয়া সত্ত্বেও বেশির ভাগ গ্রাহক সেখানে যান। কিন্তু যেসব সেবা শুধু সরকারি ব্যাংকেই আছে সে ক্ষেত্রে দুর্ভোগ অব্যাহত।
বিদেশযাত্রীদের (ভারতে) মধ্যে যাঁরা বিমানে যান, তাঁদের ট্রাভেল ট্যাক্স বা ভ্রমণ কর টিকিটের সঙ্গেই নেওয়া হয়। কিন্তু স্থলপথে যাঁরা ট্রেনে বা বাসে যান, তাঁদের স্থলবন্দরে গিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে ভ্রমণ কর দিতে হয়। কিন্তু বাস ও ট্রেনযাত্রীদের জন্য এ জন্য সমস্যায় পড়তে হয়। স্থলবন্দরে ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার সুযোগ থাকলেও সেটি সব সময় খোলা থাকে না। সকাল ৯টার আগে ও বেলা আড়াইটার পর (রোজার সময়সূচি) ব্যাংক বন্ধ থাকে। এ কারণে স্থলপথের যাত্রীরা ঢাকা থেকে ভ্রমণ কর পরিশোধ করে যান। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে প্রত্যেক সেবাপ্রার্থী বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগে পড়েন।
ঈদের ছুটিতে সিলেট হয়ে শিলং যাব বলে আগেভাগে বাসের টিকিট কিনেছি। কেননা, ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ ঘোষণা সত্ত্বেও গত চার বছরে ঢাকা গুয়াহাটি বিমান চালু করা হয়নি। এটি দুই সরকারের কারও অগ্রাধিকারে আছে বলেও মনে হয় না। তারা মনে করে, কানেকটিভিটি মানে নেতাদের ঘন ঘন বৈঠক, মোলাকাত।
প্রাইম ট্যুর নামের যে প্রতিষ্ঠানটি ভ্রমণের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়েছে, তার প্রধান মোহাম্মদ আমিনুর রহমানই টেলিফোন করে আমাকে পরামর্শ দিলেন ভ্রমণ কর যেন ঢাকায় জমা দিয়ে যাই। না হলে তামাবিলে সমস্যা হতে পারে। কখন ব্যাংক খুলবে, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তিনি বললেন, তাঁর জানামতে সোনালী ব্যাংকের দুটি শাখায় ভ্রমণ কর নেওয়া হয়। দিলকুশা ও মতিঝিলের প্রধান কার্যালয়।
বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় মগবাজার থেকে রওনা দিয়ে মতিঝিলে পৌঁছালাম ১০টায়। রোজার দিন সকাল সাড়ে ৯টায় ব্যাংক খোলে। ভাবলাম, সদর অফিসে ভিড় বেশি হবে। দিলকুশা শাখায় যাওয়াই সুবিধাজনক হবে। তিনতলার নির্দিষ্ট ডেস্কে গিয়ে এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, ভ্রমণ কর জমা দিতে এসেছি। তিনি নিরাসক্ত কণ্ঠে বললেন, দেরি হবে। কেন দেরি হবে? বললেন, যিনি কাজটি করেন, তিনি এখনো আসেননি। কখন আসবেন জানতে চাইলে বললেন, জানি না। আপনি সদর অফিসে গিয়ে জমা দিন।
এরপর সদর অফিসে গিয়ে দেখি লম্বা লাইন। ৩০–৩৫ জনের কম নয়। অনেকে বাচ্চাদের নিয়ে এসেছেন। ভেতরে প্রচণ্ড গরম। ২৯ নম্বর কাউন্টারে একজন মাত্র কর্মী ব্যাংকের রসিদ বই নিয়ে বসে আছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশে সরকারি ব্যাংকের বেশির ভাগ কাজ হয় হাতে-কলমে। তিনি সেই রসিদ বইয়ে একাধিক কার্বন পেপার রেখে নাম–ঠিকানা লিখে একটি কপি নিজের কাছে রেখে বাকি দুই পাতা সেবাপ্রার্থীকে দিচ্ছেন। টাকা গুনে নিচ্ছেন। প্রতি পাসপোর্টে কমপক্ষে দুই মিনিট সময় লাগছে। ৩০ জনের টাকা জমা দিতে লাগছে এক ঘণ্টা। এর মধ্যে লাইন আরও দীর্ঘ হচ্ছে। তাঁর পাশে অন্য কর্মীরা চেয়ারে বসে আছেন। কর্মহীন। কিন্তু সরকারি ব্যাংকে তো একজনের কাজ আরেকজনে করে দেওয়ার নিয়ম নেই। আর সেই নিয়ম যিনি বেঁধে দেবেন, তাঁকেও খুঁজে পাওয়া গেল না।
স্থানীয় শাখার ব্যবস্থাপকের কক্ষে গিয়ে দেখি, চেয়ার খালি। তখন সকাল সাড়ে ১০টা। তাঁর সহকারীকে জিজ্ঞেস করলম, ম্যানেজার সাহেব কোথায়? বললেন, তিনি জ্যামে আটকা পড়ে আছেন। ঘণ্টাখানেক পর ফের ওই কক্ষে গিয়ে জানতে চাই, ম্যানেজার সাহেব এসেছেন। সহকারী বললেন, তিনি এসেছিলেন। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়েছেন।
ঈদের আগে সোনালী ব্যাংকের প্রধান শাখার ব্যবস্থাপক এভাবে দীর্ঘ সময় অফিসে অনুপস্থিত থাকতে পারেন, ভাবতেও অবাক লাগে। তাঁর পক্ষে সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলবেন, এমন কাউকে পাওয়া গেল না। তবে সব শাখার ব্যবস্থাপনা এতটা খারাপ নয়। অনেক শাখায় দেখেছি, ব্যবস্থাপকেরা সেবাপ্রার্থীদের কাছে এসে খোঁজ নিচ্ছেন, তাঁদের সাধ্যমতো সহায়তার চেষ্টার করছেন। তাঁদের কারণেই হয়তো সরকারি ব্যাংকে এখনো লালবাতি জ্বলেনি। তবে সরকারি ব্যাংকের এই উদাসীন কর্মসংস্কৃতির পরিবর্তন করা উচিত।
আর বিশাল ঢাকা শহরে গুটিকয়েক কয়েক শাখায় কেন ভ্রমণ কর দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে? কেন সেটি বেশির ভাগ শাখায় নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে না? এই প্রশ্নের জবাব সরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপকদের কাছে চাওয়া নিশ্চয়ই গুরুতর অপরাধ হবে না।