স্বদেশ ডেস্ক:
রাজশাহী জেলায় ঘোষিত ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ১০ দিন আগে থেকেই আম পাড়ার তারিখ নির্ধারণ করার পর বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ১০ দিন আগে আম পাড়ার তারিখ ঘোষণা করা নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। অনেকে একে ‘ভুল’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবার অনেক আম চাষী এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।
গত বছর মে মাসের ১৩ তারিখ থেকে গুটি আম পাড়া শুরু হয়েছিল। তবে এবার ৪ মে থেকেই এই আম পাড়া যাবে বলে এ বছরের ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডারে উল্লেখ করা হয়েছে।
সমালোচনাকারীরা বলছেন, এমন সিদ্ধান্তের কারণে আম চাষীরা ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। কারণ ৪ মে থেকে গুটি আম পাড়া শুরুর কথা বলা হলেও এখনো অনেক আম পরিপক্ক হয়নি।
তবে জেলা প্রশাসন অবশ্য বলছে যে, বাজারে মানসম্মত আম নিশ্চিত করতেই চাষীদের স্বার্থের দিক বিবেচনা করে এই ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয়েছে।
ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার কী?
রাজশাহী অঞ্চল আমের জন্য বিখ্যাত। জেলা প্রশাসন বলছে, স্থানীয় এই সুনাম ধরে রাখতে এবং বাজারে মানসম্মত আমের সরবরাহ নিশ্চিত করতে ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার তৈরি ও প্রকাশ করা হয়।
রাজশাহী জেলা প্রশাসন এই ক্যালেন্ডার তৈরি ও প্রকাশ করে থাকে।
রাজশাহীর জেলার প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, জেলায় উৎপাদিত বিভিন্ন জাতের আম কোন সময় থেকে বিক্রির জন্য পাড়া শুরু করা যাবে তার সময়সীমা উল্লেখ করে তালিকা প্রকাশ করা হয়। স্থানীয়ভাবে এই তালিকাকে বলা হচ্ছে ‘ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার’।
২০১৭ সাল থেকে জেলায় ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার প্রকাশিত হয়ে আসছে।
এবারের প্রকাশিত ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, ৪ মে থেকে গুটি আম পাড়া যাবে। এছাড়া ১৫ মে থেকে গোপালভোগ, ২০ মে থেকে রানীপছন্দ, লক্ষণভোগ বা লখনা, ২৫ মে থেকে হিমসাগর বা খিরসাপাত, ৬ জুন থেকে ল্যাংড়া, ১০ জুন থেকে আম্রপালি, ১৫ জুন থেকে ফজলি, ১ জুলাই থেকে আশ্বিনা, বামি আম-৪, গৌড়মতি এবং ২০ আগস্ট থেকে ইলামতি আম পাড়া যাবে।
১০ দিন আগানো নিয়ে বিতর্ক কেন?
হাসিব ভদ্র নামে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, আম পাড়ার ক্যালেন্ডারটি মতামতের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। বিচার-বিশ্লেষণ বা বাস্তবিক কোনো অভিজ্ঞতা থেকে এই সময়সূচি তৈরি করা হয়নি।
‘রাজশাহীর আমের যে সুনাম রয়েছে সারাদেশজুড়ে তা ক্ষুন্ন হতে পারে এই সময়সূচির জন্য। উক্ত দফতরের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি আপনাদের ভূল সংশোধন করে নিবেন,’ লিখেছেন তিনি।
ফাহিম আহমেদ শুভ লিখেছেন, ‘গুটি আমগুলো ১০ তারিখে ডেট করা দরকার ছিল। বাকিগুলো ৭-১০ দিন বাড়ানো হলে সব থেকে ভালো হতো। এই আম গাছে মুকুল আসছিল তিন সময়ে। সেই হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে উপরে আম আটি দরালে কিন্তু নিচের গুলো দরায় নাই।’
ভিন্নমত দিয়েছেন রাজশাহীর বাঘা এলাকার আমচাষী মিঠুন হাসান। এবছর গুটি, হিমসাগর, ল্যাংড়া, লখনা, আশ্বিনী আম রয়েছে তার বাগানে। তিনি জানান, ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রথম দিনেই আম পেড়েছেন। আর সেগুলো বিদেশ পাঠানোরও ব্যবস্থা করেছেন।
তার মতে, এবার তার বাগানের গুটি আম অনেকটা আগে পেকেছে। আম পাড়ার সময় যদি আরো পেছানো হতো তাহলে তিনি ক্ষতির মুখে পড়তেন। জেলা প্রশাসনের ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডারের সময় সঠিক হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘লখনা, হিমসাগর যদি আরো পিছনে দেয় তখন আমরা প্রবলেমে পড়ি। এই জন্যে যেহেতু আগের (তাড়াতাড়ি) হইছে, আমাদের জন্য ভালো, আমটা নষ্ট হয় কম।’
‘এই বছর যেটা করছে সেটা ঠিকই আছে। বিগত পিছনে যে বছরগুলো ছিল সেগুলো নিয়ে আমরা দুর্ভোগে পড়েছিলাম।’
জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, এবার যেহেতু বেশি খরা ছিল সেজন্য আম পাড়ার তারিখ কিছুটা এগিয়ে আনা হয়েছে। এমন আবহাওয়ার কারণে বাঘা উপজেলার কিছু বাগানে গুটি আম পাকতে শুরু করায় তারিখ এগিয়ে আনার বিষয়টিতে জোর দেয়া হয়েছে।
‘কিছু বাগানে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু আম পাকছে যেগুলো কৃষকরা বাজারজাত করতে চায়। এই কৃষককে যদি আরো ১০ দিন পর্যন্ত ওয়েট করতে হয়। তাহলে কিন্তু তার আমগুলো নষ্ট হলে সে বাজারমূল্য থেকে বঞ্চিত হবে।’
আম পাড়ার সময়সীমা এগিয়ে আনার বিষয়ে শামীম আহমেদ বলেন, ৪ মে থেকে আম পাড়া শুরু করার কথা বলা হয়েছে। যাদের আম পাকেনি তারা আম পাকার জন্য অপেক্ষা করতে পারবে। এতে কোনো বাঁধা নেই।
তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে এই দিন থেকে তারা আম নামাতে পারবে। তার মানে এই নয় যে, সব আম নামিয়ে ফেলতে হবে।’
বাঘা উপজেলার তুলনায় গুদাগারী এলাকায় আম আরো পরে পাকতে শুরু করে উল্লেখ কলে শামীম আহমেদ বলেন, পাড়াভিত্তিক তারিখ নির্ধারণ করা কষ্টসাধ্য। এজন্যই প্রাথমিকভাবে একটি তারিখ নির্ধারণ করা হয় যে ওই নির্দিষ্ট তারিখ থেকে তারা আম পাড়া শুরু করতে পারবে।
কেন এই ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার?
অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে অপরিপক্ক আম কার্বাইড দিয়ে পাকিয়ে বাজারে আনতে না পারে সেজন্য পুরো বিষয়টি একটি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ের মধ্যে আনতেই ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয় বলে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন।
তবে কিছু বাগানে যদি আগেই আম পাকতে শুরু করে তাহলে সেগুলো যাতে নষ্ট না হয়, বাজারজাত করতে যাতে চাষীদের সমস্যা না হয় এবং কুরিয়ার সার্ভিসও যাতে সেই আম পরিবহনে কোনো আপত্তি তুলতে না পারে সেজন্য ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার গুরুত্বপূর্ণ।
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক বলেন, ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার চালু করার ফলে মানুষের মধ্যে অপরিপক্ক আমের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। ফলে অপরিপক্ক আম পরিবহন, বাজারজাতকরণ এবং ক্রয়ের ক্ষেত্রে এটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
যেভাবে তৈরি হয় ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার তৈরিতে একটি প্রক্রিয়া মানা হয়।
উপজেলা পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা বিভিন্ন এলাকায় কৃষক ও আমচাষীদের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেন যে আম পাড়ার সময় কখন থেকে শুরু হতে পারে।
এছাড়া এই কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন করে বাগানে আম পাকার খোঁজ খবরও সংগ্রহ করে থাকেন। সেই সব তথ্যের ভিত্তিতে আম পাড়ার সময়সীমা বা ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয়।
ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার কার্যকর বা বাজারে যাতে অপরিপক্ক আম না আসতে পারে তার জন্য চাষী এবং কৃষি বিভাগকে নিয়ে একটি ডেস্ক গঠন করা হয় বলেও জানান জেলা প্রশাসক।
ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার তৈরি হওয়ার পর একটি বৈঠকের মাধ্যমে জেলা প্রশাসন এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে।
এটি কী বাধ্যতামূলক?
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ জানান, ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার আসলে কোনো স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম নয়। তাই এটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মানতে হবে সেটিও বাধ্যতামূলক নয়।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, যেসব আম জুন মাসে পাড়া শুরু করার কথা বলা হয়েছে সেগুলো যদি অপরিপক্ক অবস্থায় মে মাসেই পাড়া হয় এবং কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়, তাহলে সেটি ধরা পড়লে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কিন্তু সেই আম যদি জুন মাসের আগেই পরিপক্ক হয় এবং পাকতে শুরু করে তাহলে সেটি বাজার জাত করতে কোনো বাধা নেই। এক্ষেত্রে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন তাদের জানাতে হবে।
শামীম. আহমেদ বলেন, ‘সেটা আমরা অবশ্যই অ্যালাউ করব। কিন্তু অপরিপক্ক আম কার্বাইড দিয়ে সেটা আমাদের রাজশাহীর ঐতিহ্য সারা দেশব্যাপী নষ্ট হোক সেটা আমরা হতে দেবো না।’
সূত্র : বিবিসি