সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:০১ অপরাহ্ন

যে কারণে আবারো ক্ষমতায় মোদি

যে কারণে আবারো ক্ষমতায় মোদি

বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতে আবারো ক্ষমতায় নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি। ক্ষমতায় বিজেপির এভাবে ফিরে আসাটা অনেকের কাছেই মিরাকেল বা ম্যাজিক বলে মনে হয়েছে। কারণ বিগত শাসনামলে মোদি সরকার অনেকবারই এমন পরিস্থিতিতে পড়েছিল যে, মানুষ ধারণা করেছিল ভারতবাসী মোদির হাত থেকে নিস্তার চায়। মূলত বিগত নির্বাচনে দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো পুরো না করা, অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে হঠাৎ করে নোট বন্ধ করে দেয়া, প্রতিবেশী দেশের সাথে যুদ্ধ নিয়ে বাগাড়ম্বর করা, উগ্র হিন্দুত্ববাদ ইত্যাদি কারণে মোদির জনপ্রিয়তার পারদ নি¤œমুখীই ছিল।

২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, প্রতি বছর তিনি এক কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন। কিন্তু চলমান বাস্তবতা ছিল, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাঝে শতকরা প্রায় ৫০ শতাংশেরই কোনো সুনির্দিষ্ট কাজ নেই। ২০১৬ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ১ ভাগ, ২০১৭ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৭ ভাগ। তার সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও ব্যাপক। এ ছাড়া তিনি গত পাঁচ বছরে ব্যাপকভাবে বিদেশ সফর করেও সেভাবে বিদেশী বিনিয়োগ আনতে পারেননি। আর তিনি সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত হয়েছেন এনআরসি নিয়ে।

এত কিছুর পরও মোদি যেভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার বন্দোবস্ত করেছেন, তাতে সে দেশেরই অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের চোখ কপালে উঠেছে। তবে লোকসভা নির্বাচনে মোদির দল বিজেপি জয়ী হওয়ার পর অবশ্য তারা এ ফলাফলের নেপথ্য কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে, একটা কথা মনে রাখা দরকার, নির্বাচনে জয়-পরাজয় ভারতের মতো বৃহত্তম গণতন্ত্রে কোনো একটা কারণে হয় না। জয়ের পেছনে অনেক কারণ থাকে।

২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি দলের চেয়ে ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদি অনেকটাই বড় হয়ে উঠেছিলেন। নির্বাচনী প্রচারণায় নিজের ইমেজকে খুব ভালোভাবে ব্যবহার করেছেন মোদি। যেভাবেই হোক, তিনি দেশবাসীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, একটি নিরাপদ, শক্তিশালী ও দারিদ্র্যমুক্ত ভারত গড়তে তার কোনো বিকল্প নেই। ধর্ম আর কট্টর জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মিশ্রণে মোদি নতুন এক রাজনীতির সূচনা করেছিলেন, যা সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেছে। ফলে অনেক বিতর্ক থাকার পরও অনেক মুসলিম অধ্যুষিত আসনে জয় ছিনিয়ে আসতে সক্ষম হয় বিজেপি।

ভারতের মতো বড় একটি দেশের জন্য একজন শক্তিশালী নেতা প্রয়োজন। বিজেপি এ ক্ষেত্রে ভোটারদের চোখে মোদিকে উঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বিরোধী দল তথা কংগ্রেস বা ভিন্ন কোনো জোট হোক, তারা তাদের মূল নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী কে হবে তা উপস্থাপন করতে পারেনি। রাহুল গান্ধী কোনো অবস্থাতেই মোদির বিকল্প ছিলেন না। উপরন্তু মোদি এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত অর্থাৎ নির্বাচনের আগে ১ দশমিক ৫ লাখ কিলোমিটার ভ্রমণ করেছেন ও ১৮২টি নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। একই সাথে অমিত শাহ ভ্রমণ করেছেন ১.৫৮ লাখ কিলোমিটার আর ভাষণ দিয়েছেন ১৬১টি নির্বাচনী জনসভায়। মোদি-অমিত শাহ জুটির কাছে রাহুল-প্রিয়াঙ্কা জুটি ছিলেন অনুজ্জ্বল। রাহুল-প্রিয়াঙ্কার বাইরে অন্য কোনো সিনিয়র কংগ্রেস নেতাকেও এভাবে গ্রামে গ্রামে যেতে দেখা যায়নি।

বিজেপি একটি জিনিসে নিজেদের ব্যাপক পারঙ্গম বলে প্রমাণ করেছে। পুলওয়ামার ঘটনাকে তারা পুরোপুরি নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের আকাশসীমায় ঢুকে ভারতীয় বিমানবাহিনী বালাকোটে হামলা চালিয়ে আসে। বিষয়টি নিয়ে বহু বিতর্ক থাকলে জনমত জরিপে দেখা গেছে, এ ঘটনাকে পছন্দ করছে ভারতের বহু মানুষ। এ ছাড়া বাজেটের সময় প্রান্তিক কৃষকদের প্রতি বছরে ছয় হাজার রুপি দিয়ে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি এবং আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া ১০ শতাংশ মানুষের সংরক্ষণের ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ বাজেট ইত্যাদি জাতীয় সবকিছুকেই নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করে সফল হয় বিজেপি। ভারতের মতো দেশে অহিংসার রাজনীতিতে যে হালে পানি পায় না, কংগ্রেস ও তৃণমূলের ভরাডুবিই তার প্রমাণ।

নির্বাচনের আগে ট্রাম্প কার্ডের মতো প্রিয়াঙ্কাকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের সাধারণ সম্পাদক বানিয়ে দেয়। কিন্তু প্রিয়াঙ্কার ক্যারিশমা মোটেও আশাপ্রদ ছিল না। ফলে কংগ্রেস এ ক্ষেত্রে কৌশল বাছতে ভুল করেছে তা বলাই যায়। এ ছাড়া কংগ্রেসবহুল অনেক আসনে বিজেপির জয় পাওয়ার পেছনেও রাহুলকে দায়ী করছেন অনেকে। তারা বলছেন, রাহুলের উদাসীনতার কারণেই কংগ্রেস এমন ফলাফল করছে। অনেকে বলছেন, পুরো গান্ধী পরিবারকেই আসলে শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন ছিল। আর লোকসভা নির্বাচনে তারই প্রতিফলন দেখা গেছে।

গত বছরের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি বেশ খারাপ ফল করেছিল। এ কারণে কংগ্রেসসহ বিরোধী দলগুলোর আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে উঠেছিল। তারা সেই ফলকেই বিজেপির পতনের শুরু বলে ধারণা করেছিল। ফলে নিজেদের কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করেনি তারা। অন্য দিকে, বিজেপি সেই ফলকে সামনে রেখে কঠোর পরিশ্রম করে পুরো দৃশ্যপটই পাল্টে দেয়। ফল দেশজুড়ে নিরঙ্কুশ বিজয়।

লোকসভা নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের মধ্যে অনৈক্য বিজেপিকে অনেকটাই সুবিধা করে দিয়েছে। শেষ মুহূর্তে এসে অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু কংগ্রেসসহ প্রধান প্রধান বিরোধী দলকে এক পতাকাতলে আনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কংগ্রেস, তৃণমূল, বহুজন সমাজবাদী দল, সমাজবাদী দল, আমজনতা পার্টি, এমনকি বামদের নিয়েও একটা ঐক্যের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ভোটের ফলাফলে তাতে কোনো প্রভাব ফেলেনি।

সাধারণভাবে সরকারে যে দল থাকে দুর্নীতি বা বিভিন্ন অভিযোগে তারাই বেশি নাস্তানাবুদ থাকে। কিন্তু বিজেপির কৌশলে পড়ে রাফাল বিমান দুর্নীতি নিয়ে ব্যস্ত ছিল কংগ্রেসই। ফলে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বিজেপিকে তেমন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি।

কাশ্মিরের পুলওয়ামায় সন্ত্রাসী হামলার জবাব হিসেবে পাকিস্তানে বিমান হামলার পর নরেন্দ্র মোদির জয়ের সম্ভাবনা অনেকখানি বেড়ে যায়। বালাকোটে বিমান হামলা চালানোর পর দলটির নেতারা দাবি করেছিল ভারত এখন শক্ত ও নিরাপদ নেতৃত্বের হাতে রয়েছে। অন্য দিকে, যেসব দল দেশের নিরাপত্তার পাশাপাশি বিশ্ব শান্তির কথা বলেছিল, তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছে ভোটাররা।

বিজেপির শাসনামলে যে বিতর্কিত বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল এই এনআরসি। যার দ্বারা বিভিন্ন প্রদেশের বাংলাভাষী মুসলমানদের ভারত থেকে বহিষ্কার করার কথা রয়েছে। কংগ্রেসসহ বিভিন্ন দল এর কিছুটা বিরোধিতা করলেও নির্বাচনের বাজারে যে এটি বিজেপির জন্য ইতিবাচক হয়েছে, তার ফলেই প্রমাণ পাওয়া গেছে।

যতই ধর্মনিরপেক্ষতার ধুয়া তোলা হোক না কেন, ভারত এখনো উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ চরিত্রই ধরে রেখেছে। যার ফলে গত মেয়াদে শুধু গরু নিয়ে ভারতে যতগুলো হামলা নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তা নির্বাচনের ফল পাল্টে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল যেকোনো সুশীল সমাজের। কিন্তু সর্বশেষ লোকসভার নির্বাচনে প্রমাণ করে দিয়ে গেল যে, দেশটিতে এখনো উগ্র জাতীয়তাবাদই ভোটারদের পছন্দের শীর্ষে।

আধুনিক প্রযুক্তিতে আপডেটেট মোদি এবারের প্রচারণায় ছিলেন খুবই সরব। সরকারি ওয়েবসাইট থেকে বিলবোর্ড, কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড থেকে পত্রিকার পাতার বিজ্ঞাপনে ও টিভির অনুষ্ঠানে মোদির সরব উপস্থিতি খুবই লক্ষণীয়। তার দল ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপি ‘নরেন্দ্র মোদি স্মার্টফোন অ্যাপ’ এর মাধ্যমে ‘নমো এগেইন’ নামে টি-শার্ট, মগ বিক্রি করছে তহবিল জোগাড় করার জন্য। মোটকথা এমন কোনো পন্থা ছিল না, যে পন্থা ব্যবহার করে বিজেপি নিজেদের আখের গোছানোর চেষ্টা চালায়নি। এ ক্ষেত্রে বিরোধীদের অবস্থান ছিল পুরোপুরি নিষ্প্রভ।

একসময় যে বামফ্রন্টকে ভারতে অন্যতম বিকল্প শক্তি হিসেবে চিন্তা করা হতো, সেই বাম রাজনীতির এখন ধার হারিয়েছে। বাম সমর্থকরা এখন আশ্রয় নিয়েছে গেরুয়া শিবিরে। পশ্চিমবঙ্গে যেখানে বিজেপির আসন তৃণমূলের প্রায় সমানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে বামরা পুরোপুরি বিপর্যস্ত।

সব মিলিয়ে ফল এটাই যে, বিজেপি টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায়। আর কংগ্রেসসহ কোনো দলই আক্ষরিক অর্থে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেনি। ২০১৪ সালে যে ‘মোদি ম্যাজিক’ নরেন্দ্র দামোদর মোদিকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল, সেই ‘মোদি ম্যাজিক’-এর ওপর ভর করে আবারো সরকার গঠন করছে বিজেপি। তবে বিজেপি তথা মোদির এ ক্ষমতায় ফিরে আসা ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য কতটুকু মঙ্গলজনক হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877