ঈদের আনন্দ ছুঁইছে না আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত চকবাজারের চুরিহাট্টার ২০০ পরিবার। অনেক পরিবার এখনো বয়ে চলছে স্বজনহারানো সেই দুঃসহ স্মৃতি। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অনেক পরিবারে বিরাজ করছে অনিশ্চয়তা আর হাহাকার। এ দিকে ঈদ দরজায় কড়া নাড়লেও ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পরিবার এখনো ভুলতে পারছেন না বিভীষিকাময় অধ্যায়ের সেই বেদনার কথা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে আয় উপার্জনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় অনেক পরিবার ইতোমধ্যে চকবাজার এলাকা ছেড়ে চলে গেছে অন্য কোথাও। আর্থিক ক্ষতি থেকে এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি অনেক ব্যবসায়ী। এবার ঈদে অনেকেই ব্যবসার পুঁজি থেকে কেনাকাটা করার খবরও জানিয়েছেন। চুড়িহাট্টার ব্যবসায়ী, সন্তান হারানো পিতা আবার পিতা হারানো সন্তান এমন ব্যক্তিরা জানিয়েছেন তাদের নিরানন্দ ঈদের প্রস্তুতির কথা। অপ্রকাশিত দুঃখবোধ আর নানা সমস্যার কথাই উঠে এসেছে আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের মুখে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর পুলিশের রিপোর্টে অনুযায়ী আগুনে পুড়ে মোট ৬৭ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে লাশগুলো কয়েক দফায় স্বজনদের কাছে হস্তান্তরও করা হয়েছে। আর পরে সিআইডির লাশ এবং স্বজনদের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে আরো দুটি লাশ হস্তান্তরের কথা বলা হয়েছে। অন্য দিকে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির তালিকার মধ্যে দেখা গেছে চুড়িহাট্টায় আগুনের ঘটনায় মোট ৭৬ জন হতাহত হয়েছেন। চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয় ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাস সুমনের স্ত্রী বিবি হালিমা ওরফে শিল্পী। রেখে যায় ফুলের মতো মিষ্টি দুই মেয়ে সন্তান। সুমন তার স্ত্রীর লাশটি এখনো খুঁজে পাননি। এবার ঈদে মা হারানো দুই শিশু সন্তানের বায়না কিভাবে মেটাবেন সুমন সেই ভাবনাতে এখন থেকেই অস্থির সুমন। নয়া দিগন্তকে তিনি জানালেন, আমার জীবনে এখন কোনো নিয়মের রুটিন নেই। দুই মেয়ের নানা বায়না আর আবদার মেটাতেই ব্যস্ত সময় পার করতে হয় আমাকে। নিজের ব্যবসার প্রতিও নজর দিতে পারি না। কর্মচারী দিয়ে কোনোমতে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছি মাত্র। ঈদের পরিকল্পনা বিষয়ে তিনি জানালেন, ভাবছি দুই মেয়েকে নিয়ে ঈদের পরেই দূরে কোথাও বেড়াতে যাবো। মেয়ে দুটির তো আর ঈদের আনন্দ হবে না। ঘুরে ফিরে যদি সময়টা পার করা যায়, সেই চেষ্টাই করব। চার বছরের ছোট্ট ছেলে মোহাম্মদ শামসুল আরেফীন। সেদিনের আগুনে হারিয়েছে বাবা মাসুদ রানাকে। মাসুদ রানার দোকান ছিল ওয়াহেদ ম্যানসনের নিচ তলায়। বাবাকে ছাড়া এবার এই শিশুটির ঈদ কেমন যাবে তা সহজেই অনুমেয়। ছোট্ট এই শিশুটির দাদা সাহেব উল্লাহ জানালেন, এ বছর আমাদের কোনো ঈদ নেই, ঈদের আনন্দও নেই। ঈদের দিন ছোট্ট এই নাতিকে কিভাবে সামাল দেবো সেই ভাবনাতেই মন ব্যথাতুর হয়ে উঠছে। চুরিহাট্টায় আগুনে নিহত হয়েছেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।
ঢাকায় থাকতেন স্ত্রী পুত্র আর কন্যাকে নিয়ে। ব্যবসা করতেন বিকাশের। স্বামীকে হারিয়ে স্ত্রী নাহিদা এখন দুই সন্তানকে নিয়ে দু’চোখে শুধুই অন্ধকার দেখছেন। এবার ঈদ নিরানন্দই কাটবে এই পরিবারের। অন্য দিকে, ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্যমতে, চকবাজারে পুড়ে যাওয়া ভবন ওয়াহেদ ম্যানশনের তিনটি ফ্লোর এবং আশপাশের ভবনের ২৫ থেকে ৩০ জন ব্যবসায়ী আগুনে তাদের সর্বস্ব হারিয়েছেন।
এ ছাড়া পরোক্ষভাবে আরো প্রায় শতাধিক ব্যবসায়ী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলায় প্লাস্টিক সামগ্রীর পাইকারি ব্যবসায়ী এম এ রহিম। তার দোকানের নাম ছিল আইভেল এন্টারপ্রাইজ। তিনি জানান, আগুনে আমার সব পুড়ে গেছে। এক টাকার মালামালও অবশিষ্ট ছিল না। একই কথা জানালেন, ওয়াহেদ ম্যানশনের পাশের ভবনের ব্যবসায়ী নাহিদ। তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লাজিবা এন্টারপ্রাইজ। তিনিও কয়েক লাখ টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। একই কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ী আব্দুল মান্নান, আলমগীর, মফিজুর রহমান। এসব ব্যবসায়ীর কোনো পরিবারকেই স্পর্শ করতে পারেনি ঈদের আনন্দ।