শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৫ পূর্বাহ্ন

হারিয়ে যাওয়া শরৎ ও হেমন্তের খোঁজে

হারিয়ে যাওয়া শরৎ ও হেমন্তের খোঁজে

“আজ অনবরত মেঘের জল ঝ’রে ঝ’রে আকাশ কেমন সুনির্মল সাজেই না সেজেছে, আজকের দিনে কাঞ্চন ফুলের গাছগুলো কার মন না কাড়ছে, বল ত? তুমিই বল, এসব দেখেও কোন যুবকের মন স্বাভাবিক বজায় থাকতে পারে?” শরৎকে এমনভাবেই বর্ণনা করেছেন কবি কালিদাস। বর্ষার অঝর বৃষ্টিতে একটু স্বস্তি নিয়ে আসে শরৎ। বর্ষার পর শরৎ আসে প্রকৃতিতে শুভ্রাকে নিয়ে। বাংলা সাহিত্যের নানা উপময় শরতের শুভ্রতাকে ব্যবহার করা হয়। বসন্তের মতো চোখধাঁধানো রূপের জৌলুস না থাকলেও শরতের আছে আকাশজুড়ে সাদা মেঘের বাহার। নদীর রুপালি সৌন্দর্য, যা আরও ফুলেফেঁপে ওঠে নদী অববাহিকার কাশবনে। শরৎ ঋতুকে সবচেয়ে মধুমাখা করে তোলে বাড়ির উঠানের শিউলি ফুলের গাছ। রাতে ফোটা শিউলি সারাদিন বাড়ির চারপাশকে মোহনীয় করে রাখে। তবে এখন বাড়ি বলতে তো নগরে ফ্ল্যাটবাসা। ফলে নগরবাসীদের জন্য শিউলির সুরভির আমেজ নেওয়ার সুযোগ কই?

ষড়ঋতুর এই দেশে শরৎ ঋতুতে ফুল ও ফলের উপস্থিতি কম। শরতে ফুলবতী হয় ছাতিম, কুল ও কাশ, গন্ধভাদালি, পান্থপাদপ, শিউলি, আকাশিয়া, ইপিল ইপিল ইত্যাদি। শরতের ফলবতী গাছের মধ্যে তাল, খেজুর, কাঠবাদাম, নারিকেল, বাতাবিলেবুসহ আরও কিছু।

শরতেই সবচেয়ে পরাক্রমশালী পশু বাঘিনী প্রসবিনী হয়। এসব বয়ান তো প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু শিউলি ফুল থেকে বাতাবিলেবুর গাছও এখন সহজলভ্য নয়। কোথায় দেখাব এ প্রজন্মকে শিউলি ফুল কীভাবে শরতের মৃদুমন্দ হাওয়ায় কী করে ভোররাতে বাড়ির উঠানে ফুলের বিছানা সাজিয়ে রাখে ভোরে ঘুম থেকে ওঠা মানুষের জন্য।

শরতের শ্বেত-শুভ্রতা বাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশে অনন্যতার দাবি রাখে। বর্ষার নিকেশ কালো মেঘমালা মানুষকে ভাবকাতুর করে ফেলে। শরৎ এসে স্বচ্ছ আকাশ যেন চনমনে পরিবেশ সৃষ্টি করে। বর্ষার খরস্রোতা নদী যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে শরৎ এসে যেন নদীতে সাম্য পরিবেশের সৃষ্টি করে। নদীতে পাল তোলা নৌকা সর্পিল গতিতে চলে। কখনো বাতাসের বেগ কমে গেলে নৌকার গতিকে চলমান রাখতে গুন টানা হয়। এখন কালেভদ্রে পালতোলা নৌকা দেখা গেলেও গুণ টানা নৌকার সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে কিনা জানি না। ঋতুভিত্তিক প্রকৃতিনির্ভর জনজীবনের সঙ্গে সাযুজ্য উপকরণগুলোর উপস্থিতি এখন আর আগের মতো নেই।

ঋতু পরিক্রমায় গ্রীষ্ম নানা ফলের সমাহর ঘটালেও গরম ও কালবৈশাখী দিয়ে কম তা-ব চালায় না। বর্ষার নানা রূপ-মাধুর্য থাকলেও বন্যার মাধ্যমে ভাসিয়ে দিয়ে অনেক সময় জনজজীবন বিপর্যস্ত করে। সে তুলনায় শরতের প্রাপ্তি কম হলেও শরতের বিড়ম্বনা কম। বরং বর্ষায় কালো গুমোট ভাব কাটিয়ে রোদে মাখে শরৎ সোনালি আভা। শরতের শুভলগ্নেই সনাতনী সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজার শুরু হয়। এ যেন শরতের এক অপার মহিমা। বর্ষায় ভিজে মানুষ কিছুটা সিক্ত থাকে। শরৎ প্রকৃতি ও মানুষ এ দুটিকেই সজীব করে। এ যেন ঘিয়ে ভাজা পুরি।

শরতের নানা নান্দনিক দিক থাকলেও ঋতুবৈচিত্র্যে শরৎ অনেকটা ক্ষণস্থায়ী। শরৎ মৃণ¥য় হলেও শরতের পরের ঋতু হেমন্ত অনেক বেশি প্রভাবশালী। প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে হেমন্তের বারতা অনেক বেশি কাক্সিক্ষত। জীবনানন্দের ভাষায়Ñ “প্রথমের ফসল গেছে ঘরে, হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝ’রে/শুরু শিশিরের জল।”

হেমন্ত ফসলের ঋতু। এই ঋতুতে ফসল কৃষক ঘরে তুলে স্বস্তিতে থাকে, কৃষকের মন বছরের যে কোনো সময়ের চেয়ে সঙ্গত কারণেই ভালো থাকে। কৃষক নিজ গোলায় ধান তুলে নির্ভার হয়। আর হেমন্ত গরমের সঙ্গে শীতের সংযোগ ঘটায়। গরমকে বিদায় জানিয়ে হেমন্ত রাত্রি দ্বিপ্রহরে আকাশে ধোঁয়াশা তৈরি করে সাকালে ঘাসের ডগায় শিউলি ফুলে শিশির জমা করে।

প্রকৃতিতে শীতের আমেজ আনে হেমন্ত বায়ুপ্রবাহের দিক পরিবর্তন করে। বাংলাদেশের মৌসুমি বায়ু বঙ্গোপসাগরের দিক থেকে না এসে হিমালয় অঞ্চল থেকে প্রবাহ আরম্ভ হয় হেমন্ত ঋতুতে। ফলে হেমন্তে আগমন ঘটে হিম হাওয়ার। চালতা, কামরাঙার মতো রসালো ফল পাওয়া যায় হেমন্তে।

বাঙালি সংস্কৃতিতে যে পিঠা-পুলির সংযোগ লক্ষণীয়, তা হেমন্ত ঋতুর। নানা জাতের আমন ধান ঘরে তুলে কৃষক পরিবার নতুন ধানের সহযোগে নানা পিঠা-পুলির আয়োজন করে। গ্রামে গ্রামে পিঠা খাওয়া, মেহমান দাওয়াত দেওয়ার রেওয়াজকে নবান্ন বলেই মানা হয়। তবে আজকাল গ্রামগুলোকে শহর বানিয়ে ফেলায় নবান্ন উৎসব বলতে বিশেষ কিছু নেই বৈকি। বরং শহুরে মানুষরা হেমন্ত ঋতুতে নবান্ন উৎসব নাম দিয়ে বাণিজ্যিক উৎসবের চেষ্টা করে। কিন্তু গ্রামবাংলার মানুষের দরদমাখা এবং নিজস্ব দেশজ সংস্কৃতির সেই নবান্ন উৎসবের আমেজ শহরের নবান্ন উৎসবে পাওয়া যায় না।

গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎ গরমপ্রবণ ঋতু। হেমন্ত প্রকৃতিতে হাওয়া বদল করে দিয়ে শুধু পরিবেশে নয়, মানুষের মনেও এক নতুন মাদকতা এনে দেয়। কিন্তু প্রকৃতির পরিবর্তনগুলো উপলব্ধি করার মতো সময় ও সুযোগ কই? নগরজীবনে সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত মানুষের কাছে ঋতুবৈচিত্র্যের সৌন্দর্যের কোনো খেয়াল নেই। পাশাপাশি নির্বিচারে গাছপালা-নদ-নদী মানবসৃষ্ট কারণে ধ্বংস হওয়ায় প্রকৃতিতে ঋতুর বৈশিষ্ট্যও আগের মতো প্রতিভাস হয় না।

বাঙালির জীবনে অশনিসংকেত হচ্ছে ষড়ঋতুর বাংলাদেশে ছয়টি ঋতুর তিনটি হারাতে বসেছে। হারিয়ে যাওয়া ঋতুর তালিকায় আছে শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত। গ্রীষ্ম এখনো মাঠঘাট চৌচির করে নিজের আবির্ভাবকে জানান দেয়। বর্ষার মেঘ ও বর্ষণ ক্রিয়া করে। শীত শহুরে জীবনে খুব একটা দৃশ্যমান না হলেও গ্রামবাংলায় প্রকট। কিন্তু বসন্ত তো বোঝার উপায় রাখে না, শীত ও গরমের মাঝে কখন সে এসেছিল। এরূপ নাকাল দশায় আছে শরৎ ও হেমন্ত ঋতু। শরৎ ও হেমন্ত প্রকৃতিতে যেসব পরিবর্তন নিয়ে আসে, তাতে আমূল পরিবর্তন ঘটে না। ফলে শরৎ ও হেমন্ত ঋতু খানিক বর্ষার সঙ্গে এবং খানিক শীতের সঙ্গে মিশে গেছে। শরৎ, হেমন্ত যেন কেবল স্মৃতি এবং কাগজের পাতায় আছে।

বর্তমান প্রকৃতির অবস্থা বিবেচনায় বিলম্বিত বর্ষা ও স্থায়িত্ব দীর্ঘ হওয়ায় শরৎ ও হেমন্তকে আলাদা করে শনাক্ত করা যায় না। যান্ত্রিক সভ্যতায় দাওয়াতি কলের ধোঁয়া, বাতাসে সিসা, মানুষের চাপে একটু একটু হেমন্তের হিম কি অনুভব করা সম্ভব?

মূলত শরৎ ও হেমন্ত বর্ষা ঋতুর সহোদ।

শরৎ ও হেমন্তের পরিবর্তনগুলো প্রকৃতিতে স্বল্পমাত্রার ও ক্ষণস্থায়ী। মানবসৃষ্ট কারণে ঋতুবৈচিত্র্যের রূপের বিবর্তন এখন আর আগের মতো বর্ণিল নয়। এ জন্যও শরৎ ও হেমন্তের অবস্থা অনেকটা নতজানু।

বর্তমান বাস্তবতায় শরৎ-হেমন্ত ঋতু বর্ষার বর্ষণ কমিয়ে কোমল সোনা রোদের আবহাওয়া উপভোগের সুযোগের চেয়ে বরং ভ্যাপসা গরম ও মাঝে মাঝে বৃষ্টি নগর জীবনে ভোগান্তি বাড়ায়। এখন বৃষ্টি হলেও কেন যেন শীতলতা এনে দিতে পারে না। শরৎ-হেমন্তের বৃষ্টির সঙ্গে ভাদ্র ও আশ্বিন মাসের অসহনীয় গরম প্রতিবছর পরিবেশকে আরও অসহনীয় করে তুলছে।

আধুনিকতার সুবাদে এখন অবশ্য কার্তিক মাসে গ্রামবাংলায় হাম-কলেরার উপদ্রব ততটা দেখা যায় না। এসব ঋতুভিত্তিক রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। পাশাপাশি হেমন্তের নানা উৎসব ‘নবান্ন’ থেকে শুরু করে রাসলীলাÑ সব উৎসবেরই যেন প্রকৃতি রাশ টেনে দিচ্ছে। টিকে থাকার সংগ্রামে মানুষ দিনকে দিন যন্ত্রমানব হয়ে উঠছে। যন্ত্রমানবের সঙ্গে সঙ্গত কারণেই প্রকৃতির মোহনীয়-রমণীয় রূপ দেখার মন ও মনন কোথায়? প্রকৃতিতে শরৎ ও হেমন্তের ধবল কাশফুল, সাদা সাদা মেঘমালা যে মাত্রায় দৃশ্যমান হোক না কেন, মানুষের যদি এসবের উপভোগের মন না থাকে, তবে প্রকৃতি পাল্টাচ্ছে এ ধুয়া তুলে লাভ কী?

হেমন্ত ঋতুর ফসল তোলার মৌসুমে যে সনাতনী কৃষিব্যবস্থা ছিল, তা এখন যান্ত্রিকতার হাওয়া মাখিয়েছে। আজকাল হেমন্তে ধান কেটে আঁটি বেঁধে ক্ষেত থেকে তুলে এনে কৃষকের বাড়ির উঠানে বলদ দিয়ে সনাতন মাড়াই প্রথার বিলুপ্তি হয়েছে। যন্ত্রের সহজলভ্যতা ও বহুবিধ সুবিধার কারণে ধান কাটা থেকে মাড়াই, এমনকি ধান ভাঙানো থেকে চাল তৈরি সবটাই যন্ত্রের কাছে সমর্পিত। হেমন্তে এখন আর নানা জাতের আমনের ফলন হয় না। এমনকি কাটারিভোগ, চিনিগুঁড়া ও কালিজিরা চালেও কৃত্রিমতায় পূর্ণ।

এখন আর ফসল কাটার গান, ধান ভানার গান প্রয়োজন হয় না। যন্ত্রের তেল, মবিল পুড়িয়ে দ্রুত ফসলের রূপান্তর ঘটানো হয়।

মানুষ যতই ব্যস্ত জীবনযাপন করছে, ততই প্রকৃতি ও প্রতিবেশের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে। আর মানবসৃষ্ট কারণে প্রকৃতির ওপর অত্যাচারের ফলে নানা বিপর্যয় ঘটিয়ে প্রকৃতিও মানুষের প্রতি বিরূপ আচরণ করছে। ঋতুরঙ্গও প্রতিভাস হচ্ছে না, এ ক্ষেত্রে লুপ্তপ্রায় শরৎ ও হেমন্তের অবস্থা আরও সঙ্গীন। কিন্তু বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী যারা, তারা তো শরতের মিঠে রোদ কিংবা হেমন্তের হিম হাওয়া চাইতেই পারে। নান্দনিক ভাবনায় বাঙালি যদি জীবানানন্দ দাশকে আশ্রয় করে খুঁজতে থাকে-

‘হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়’। কিন্তু এই দেশে এখন নাবন্ন কোথায়?

খান মাহবুব : গবেষক ও খ-কালীন শিক্ষিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877