স্বদেশ ডেস্ক:
সচিবালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে বেকার তরুণ-তরুণীদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মাগুরার দোয়ারপাড়ের দুই ভাই মাহাবুবুল কাদির সাগর ও শাহিনুর কাদির সুমন। জমিজমা বিক্রি করে, স্বর্ণালঙ্কার বন্দক রেখে, এমনকি ধারদেনা করে দুই ভাইয়ের হাতে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা তুলে দিয়েছিলেন মাগুরার বিভিন্ন এলাকার ৩০-৩৫ জন চাকরিপ্রত্যাশী।
চাকরি না পেয়ে টাকা খোয়ানো এসব পরিবারের অধিকাংশই এখন পথে বসেছে। যারা ধারদেনা করেছেন, তারা তো শোধের তাগাদায় বাড়িঘরে থাকতে পারছেন না, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ আদালতে মামলা করেছেন এ আশায় যে, যদি কোনো গতি হয়! কিন্তু অগতি এ মানুষগুলোর তাদের পরিবারের কোনো গতি হয়নি। চাকরির স্বপ্ন তো অনেক আগেই ভেস্তে গেছে। এখন তাদের তাড়া করে ফেরে নানা দুঃস্বপ্ন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কড়া নিরাপত্তাবেষ্টনীতে ঘেরা দেশের প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র খোদ বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভেতরেই সক্রিয় চাকরিদাতা প্রতারকচক্রের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। বহিরাগত দালাল ছাড়াও এ চক্রে জড়িত সচিবালয়েই কর্মরত চতুর্থ শ্রেণির কিছু কর্মচারী। অফিসের সময় শেষ হয়ে গেলে যখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সচিবালয় ছাড়েন, তখন তাদের কক্ষে শুরু হয় প্রতারকদের ‘অফিস’! বছরের পর বছর ধরে চলা ভয়াবহ এ অপরাধমূলক কর্মকা- নিয়ে গত ২৯ আগস্ট ‘বিকালে পিয়নই সচিব!’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন ছাপা হয় আমাদের সময়ে। এর পর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্রকে শনাক্ত করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২৯ আগস্ট পরবর্তী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটিকে।
এদিকে প্রতিবেদনটি প্রকাশের দিনই কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে চাকরিদাতা প্রতারক চক্রের মূল হোতা সচিবালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ফরাশ শাখায় (সকালে অফিসের তালা খোলা এবং বিকালে তালাবদ্ধ করার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মচারী) পিয়ন পদমর্যাদায় কর্মরত মো. শফিকুল ইসলামকে। তবে ঘটনায় জড়িত অন্যতম প্রতারক সচিবালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী (অস্থায়ী) কেএম মোর্তুজা আলী রনি এখনো রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর চাকরির নামে টাকা নিয়ে প্রতারণা করার দায়ে ভুক্তভোগীর করা মামলার আসামি হিসেবে র্যাবের হাতে আটক হয়ে বর্তমানে জেলহাজতে আছেন মাগুরার সেই দুই ভাইয়ের একজন শাহিনুর কাদির সুমন। তবে প্রতারক চক্রের অন্যতম সদস্য সুমনের বড় ভাই মাহাবুবুল কাদির সাগর এখনো রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
জানা গেছে, সচিবালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে এ দুই সহোদরের নামে মামলা করেছেন মাগুরার মীরপাড়ার বাসিন্দা সাখাওয়াত হোসেন। মাগুরা সদর বিচারিক আদালতে করা মামলায় তিনি উল্লেখ করেছেন, তার ছেলে মাহবুবুল আলম হাসানকে সচিবালয়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলে শাহিনুর কাদির সুমন ও মাহাবুবুল কাদির সাগর ১০ লাখ টাকা নিয়েছেন। এ ছাড়া মাগুরা সদরের রূপাটি গ্রামের গোলাম রসুলের ছেলে তানভির, একই গ্রামের ওহাব মোল্যার ছেলে জাহাঙ্গীর আলম, ছানোয়ার আলী, বগিয়া গ্রামের শাহিনুর রহমান, মাঝাইল গ্রামের আবদুল্লাহ আল মামুন, মাগুরা সদরের হাজিপুর গ্রামের ইমরান সিদ্দিক, ঝিনাইদহের শ্রীফলতলা গ্রামের আবু সাঈদ আল ইমরানের কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ৭৯ লাখ টাকা নিয়েছে সুমন ও সাগর। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে নগদ ও ব্যাংক চেকের মাধ্যমে এসব টাকা সুমন ও সাগরকে দেওয়া হয়।
একই বছরের বিভিন্ন সময়ে অভিযুক্তরা আটজনকে চাকরিতে যোগদানের জন্য পৃথক নিয়োগপত্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সচিবালয়ের উপসচিব ড. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত অফিস আদেশ দেন। এসব নিয়োগপত্র ও অফিস আদেশ পেয়ে ভুক্তভোগীরা সচিবালয়ে গেলে অভিযুক্ত সুমন ও সাগর সেখানে কোনো অফিস কিংবা কাজ নির্ধারণ করে না দিয়ে বিভিন্ন দপ্তরে ঘোরাতে থাকেন। এতে ভুক্তভোগীদের সন্দেহ হলে তারা নিয়োগপত্র যাচাই-বাছাইয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখায় যোগাযোগ করেন। সেখান থেকে বলা হয়, তাদের দেওয়া এসব কাগজপত্র ভুয়া। এর পর সুমন ও সাগরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা কোনো সদুত্তর না দিয়ে টাকা ফেরত দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেন। পাশাপাশি এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে ফের যোগাযোগ করলে তাদের খুন করে লাশ গুম করে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেন। শেষ পর্যন্ত কোনো উপায় না পেয়ে তারা মামলা করতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান।
মাগুরা সদর থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম জানান, বিষয়টি তদন্ত করে যথাসময়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
মাগুরা শহরের পুরনো বাজার এলাকার বাসিন্দা মোসলেহ উদ্দিন কাশেম জানান, তিনি তার বোন ও অপর একজনের চাকরির জন্য ২০১৭ সালে সুমনকে ২৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়েছেন। পরে অভিযুক্ত ওই দুজন ভুয়া নিয়োগপত্র ও অফিস আদেশের মাধ্যমে একইভাবে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি অভিযুক্ত সুমন, সচিবালয়ের পিয়ন শফিকুল ইসলাম যিনি সচিব সেজে তার বোনের ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন, মোর্তজা রনি নামে অপর একজন যিনি সচিবের একান্ত সহকারী পরিচয় দিয়েছিলেন- এ তিনজনের নামে ঢাকার মিরপুর-২ নম্বর মডেল থানায় মামলা করেছেন। এ মামলায় গত ২ আগস্ট সুমন র্যাবের মাধ্যমে গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছে।