স্বদেশ ডেস্ক:
তুরস্কে গত সোমবার আঘাত হানা বিধ্বংসী ভূমিকম্পে মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। আজ শনিবার পর্যন্ত দেশটিতে নিহতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে তুরস্কে এত বড় মাপের ট্র্যাজেডি এড়ানো যেত কি না এবং প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সরকার মানুষের জীবন বাঁচাতে আরও কিছু করতে পারতেন কি না।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুরস্কে ১৯৩৯ সালের পর এটাই ছিল সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প। একটানা ২০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরে আসন্ন নির্বাচনে এরদোয়ানের পুনরায় ক্ষমতায় আসীন হওয়া ঝুঁকিতে পড়েছে। তার জাতীয় ঐক্যের আবেদন উপেক্ষিত হয়েছে। তবে এরদোয়ান ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছু ভুল হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
তুরস্ক দুটি ফল্ট লাইনে অবস্থিত এবং দেশটিতে ভূমিকম্পের যে বিল্ডিং কোড রয়েছে সেটি ৮০ বছরের পুরনো। তুরস্কের ৮১টি প্রদেশের মধ্যে ১০টি প্রদেশে ব্যাপক উদ্ধার অভিযানের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সাড়া পেতে অনেক সময় লেগে যায় এবং কয়েকটি গ্রামে প্রথম কয়েকদিন পৌঁছানো যায়নি।
বিবিসি বলছে, ভূমিকম্পে ছয় হাজারেরও বেশি ভবন ধসে পড়েছে এবং তুরস্কের দুর্যোগ মোকাবিলা কর্তৃপক্ষের কর্মীরা নিজেরাই ভূমিকম্পে আটকা পড়েছেন।
দুর্যোগের প্রথম কয়েক ঘণ্টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হলেও রাস্তা খারাপ থাকায় উদ্ধারকারী দলগুলোকে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন পর্যন্ত সংগ্রাম করতে হয়।
অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় তুরস্কে ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা বেশি। কিন্তু দেশটির স্বেচ্ছাসেবী উদ্ধারকারী দলের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বাস করেন, এবারের ভূমিকম্পের ঘটনায় রাজনীতি ঢুকে পড়েছে।
এর আগে ১৯৯৯ সালের অগাস্টে তুরস্কে বড় ভূমিকম্প আঘাত হানে। সেই সময় দেশটির সশস্ত্র বাহিনী ওই উদ্ধার অভিযানের নেতৃত্ব দেয়। কিন্তু এরদোয়ানের সরকার তুর্কি সমাজে তাদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল।
আকুত ফাউন্ডেশনের প্রধান, নাসুহ মাহরুকি বলেছেন, সারা বিশ্বে সবচেয়ে সংগঠিত এবং লজিস্টিকভাবে শক্তিশালী সংস্থাগুলি হল সশস্ত্র বাহিনী; তাদের হাতে প্রচুর জিনিষপত্র রয়েছে। সুতরাং এই শক্তিকে দুর্যোগের সময় ব্যবহার করতে হবে।
এর পরিবর্তে, তুরস্কের বেসামরিক দুর্যোগ কর্তৃপক্ষের কর্মী রয়েছে ১০ থেকে ১৫ হাজারের মতো। আকুতের মতো বেসরকারি সংস্থাগুলো তাদের তিন হাজারের মতো স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে সহায়তা করছে।
মাহরুকি বলেন, বর্তমানে সেনাবাহিনীর সক্ষমতা ১৯৯৯ সালের তুলনায় অনেক বেশি, কিন্তু তাদেরকে পরিকল্পনার বাইরে যে কোনো কাজ করতে সরকারের আদেশের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। এ কারণে উদ্ধার ও অনুসন্ধান অভিযান শুরু করতে দেরি হয়েছে।
এরদোয়ান স্বীকার করেছেন, তুরস্কের কাছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘তল্লাশি ও উদ্ধারকারী দল’ থাকা সত্ত্বেও সরকার যত দ্রুত অভিযান পরিচালনা করতে চেয়েছিল তত দ্রুত হয়নি।
বছরের পর বছর ধরে, তুর্কিদের একটি বড় ধরণের ভূমিকম্পের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল কিন্তু খুব কম মানুষই ধারণা করেছিলেন যে এটি পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্ট বরাবর আঘাত হানবে। এই ভূমিকম্পের প্রভাব দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত হয়েছে, কারণ বেশিরভাগ বড় কম্পন উত্তরের ফল্টে আঘাত করেছে।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে তুরস্কের এলাজিগে একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এই স্থানটি গত সোমবারে আঘাত হানা অঞ্চলের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত।
তখন ইস্তান্বুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির ভূতত্ত্ব প্রকৌশলী অধ্যাপক নাসি গোরুর এই ভূমিকম্পের ঝুঁকিটি অনুমান করেছিলেন। এমনকি তিনি আদিয়ামান এবং কাহরামানমারাস শহরের উত্তরে পরবর্তী ভূমিকম্পের পূর্বাভাসও দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, আমি স্থানীয় সরকার, গভর্নর এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে সতর্ক করেছিলাম। আমি বলেছিলাম, দয়া করে আপনার শহরগুলোকে ভূমিকম্পের জন্য প্রস্তুত করার ব্যবস্থা নিন। যেহেতু আমরা ভূমিকম্প থামাতে পারব না, তাই ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি কমাতে হবে।
তুরস্কের অন্যতম প্রধান ভূমিকম্প প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মুস্তাফা এরদিক ধারণা করছেন, বিল্ডিং কোডগুলো অনুসরণ না করার কারণে জীবনের এত বড় ক্ষতি হয়েছে। তিনি বিল্ডিং শিল্পের অজ্ঞতা এবং অযোগ্যতাকেও দায়ী করেন।
তিনি বিবিসিকে বলেন, এই ক্ষতি প্রতিরোধ করা উচিত ছিল কারণ এই ধরণের ঘটনা বড় ধরণের হতাহতের কারণ।
২০১৮ সালে হালনাগাদ হওয়া বিল্ডিং কোড মতে, উচ্চ-মানের কংক্রিটকে রিবড ইস্পাত বার দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে। লম্বালম্বি কলাম এবং আড়াআড়ি বসানো বিমগুলোর কম্পনের প্রভাব শোষণ করার সক্ষমতা থাকতে হবে।
অধ্যাপক মুস্তাফা এরদিক বলেন, সমস্ত নিয়ম মেনে চললে কলামগুলো অক্ষত থাকত এবং ক্ষতিটি বিমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু এর পরিবর্তে কলামগুলো ভেঙ্গে পড়ায় প্রতিটি তলা একে অপরের উপর ধসে পড়েছে, যার ফলে এতো হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
ভূমিকম্প কর রহস্য
তুরস্কে ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড না মানার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দেশটির বিচার মন্ত্রী এ নিয়ে বলেছেন, কেউ এই কোড লঙ্ঘন করলে তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। কিন্তু এনিয়ে অনেকে সরকারের সমালোচনা করছেন।
বিরোধী দল সিএইচপি’র নেতা কামাল কিলিকদারোওলু বলছেন, ২০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর এরদোয়ানের সরকার ভূমিকম্পের জন্য দেশকে প্রস্তুত করতে পারেনি।
১৯৯৯ সালের ভূমিকম্পের পরে দুটি ভূমিকম্প সংহতি কর নামের তহবিল তৈরি করা হয়েছিল। বিভিন্ন মোবাইল ফোন কোম্পানির ভয়েস এবং ম্যাসেজিং সার্ভিসের উপর কর, ইন্টারনেট সেবা, ক্যাবল টিভি ও রেডিও’র উপর কর আরোপ করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে তুরস্কের সরকারের কোষাগারে প্রায় সাড়ে চারশ কোটি ডলার জমা হয়।
এই তহবিল দিয়ে ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন তৈরি এবং দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য খরচ করার কথা ছিল। কিন্তু ওই তহবিলের অর্থ দিয়ে কী করা হয়েছে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। এর কোন ব্যাখ্যা সরকারের কাছ থেকে কখনোই পাওয়া যাযনি।
নগর পরিকল্পনাবিদরা অভিযোগ করেছেন, ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলগুলোতে নিয়ম মেনে ভবন তৈরি করা হয়নি। যারা নিয়ম না মেনে ভবন নির্মাণ করেছিল তাদের কিছু আর্থিক জরিমানা করে ছাড় দেয়া হয়েছিল। এর ফলে প্রায় ৬০ লাখ ভবন অপরিবর্তিত অবস্থায় থেকে যায়।
জরিমানা, ট্যাক্স এবং নানা ধরণের ফি থেকে তুরস্ক সরকারের কোষাগারে বিলিয়ন বিলিয়ন টার্কিশ লিরা জমা হয়। ২০১৯ সালে ইস্তাম্বুলে একটি আবাসিক ভবন ধসে ২১ জন নিহতের ঘটনায় তখনকার সিভিল ইঞ্জিনিয়ার চেম্বার প্রধান বলেছিলেন, এই সাধারণ ক্ষমা তুর্কি শহরগুলোকে কবরস্থানে পরিণত করবে।
ইস্তান্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেলিন পিনার গিরিটলিওগ্লুর বলেন, এবারের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি শহর থেকে এক লাখেরও বেশি আবেদন জমা পড়েছিল । এসব এলাকায় বিল্ডিং কোড না মেনে করে বহু ভবন নির্মাণ হয়েছে।
তিনি বিবিসিকে বলেন, সর্বশেষ ভূমিকম্পে এত ভবন ধসে পড়ার ক্ষেত্রে সরকারের সাধারণ ক্ষমা অন্যতম বড় কারণ।
অধ্যাপক এরদিক বলেন, আমরা একে অপরকে দোষারোপ করে কোথাও যেতে পারব না এবং আমাদের সমাধান খোঁজা উচিত। তার ধারণা, এই সমস্যার পেছনে আরেকটি বড় কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে অনেক প্রকৌশলী সামান্য অভিজ্ঞতা নিয়ে সরাসরি অনুশীলনে নেমে পড়েন।
মেরুকরণের রাজনীতি
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ে নিন্দা বা সমালোচনা না করে দেশব্যাপী ঐক্য ও সংহতির আহ্বান জানিয়েছেন। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছে হাতায় নামক অঞ্চলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, যারা রাজনৈতিক স্বার্থে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে আমি তাদের বরদাস্ত করব না।
ক্ষতিগ্রস্ত অনেক অঞ্চল তার দল একেপি পরিচালনা করে। কিন্তু এরদোয়ান প্রথমে প্রধানমন্ত্রী এবং তারপর কর্তৃত্ববাদী নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার আছেন। এর কারণে দেশটিতে রাজনৈতিক মেরুকরণের সৃষ্টি হয়েছে।
তার রাজনীতির কারণে আমরা এই অবস্থানে এসেছি, কিলিকদারোওলু বলেছেন।
মে মাসে নির্বাচনের জন্য এখনও কোন প্রচার প্রচারণ শুরু হয়নি। তবে দেশটির বিরোধী দলগুলো প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ প্রার্থী ঘোষণা করতে প্রস্তুত।
এরদোয়ান নির্বাচনের আগে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার যে কথা বলছেন, সেই আশায় গুড়েবালি পড়তে পারে। তিনি সমালোচনার ব্যাপারে ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন এবং তার অনেক প্রতিপক্ষ কারাগারে আছেন বা বিদেশে পালিয়ে গেছেন।
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা রক্তপাতের মধ্যে শেষ হয়েছিল। তখন তিনি এর প্রতিক্রিয়ায় কয়েক হাজার তুর্কিকে গ্রেপ্তার করেন এবং হাজারো সরকারি কর্মচারী বরখাস্ত করেন।
দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ৫৭% হওয়ার কারণে জীবনযাত্রার খরচ আকাশছোঁয়া হয়ে পড়েছে। ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়ায় সরকারের প্রথম পদক্ষেপগুলোর মধ্যে ছিল সাময়িকভাবে টুইটার ব্লক করা, যা তুরস্কে উদ্ধারকারীদের জীবিতদের সনাক্ত করতে সহায়তা করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছিল।
তবে সরকারের দাবি টুইটার ভুল তথ্য ছড়াতে ব্যবহার করা হচ্ছে। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা নিয়ে সমালোচনামূলক পোস্ট করার জন্য দেশটির সরকার একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকেও আটক করে।
জার্মানিতে নির্বাসিত তুর্কি সাংবাদিক ডেনিজ ইউসেল লিখেছিলেন ১৯৯৯ সালের তুর্কি ভূমিকম্প এরদোয়ানকে ক্ষমতায় আনতে সাহায্য করেছিল। এই সর্বশেষ বিপর্যয় পরবর্তী ভোটে একটি ভূমিকা পালন করবে, বলে তিনি মনে করেন। তবে সেটা কীভাবে তা এখনও পরিষ্কার নয়।