রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:২৭ অপরাহ্ন

‘বিকালের সচিব’ শফিকুল প্রত্যাহার, অধরা রনি

‘বিকালের সচিব’ শফিকুল প্রত্যাহার, অধরা রনি

স্বদেশ ডেস্ক: দেশের প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভেতরেই সক্রিয় চাকরিদাতা প্রতারকচক্রের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। এ চক্রে জড়িত সচিবালয়েই কর্মরত চতুর্থ শ্রেণির কিছু কর্মচারী। অফিসের সময় শেষে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন সচিবালয় ছাড়েন, তখন তাদেরই কক্ষে শুরু হয় প্রতারকদের ‘অফিস’! বছরের পর বছর ধরে চলা ভয়াবহ এ অপরাধ কর্মকা-ের বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার ‘বিকালে পিয়নই সচিব!’ শিরোনামে অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন ছাপা হয় আমাদের সময়ে। এর পর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। প্রতারকচক্রের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট শনাক্তে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে গণপূর্ত অধিদপ্তরের বাংলাদেশ সচিবালয়ের পিডব্লিউডি ডিভিশন।

প্রতিবেদন প্রকাশের দিনই গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. হাসান ইবনে সিরাজকে প্রধান করে ৩ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটি গঠন করা হয়। গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু করে আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কমিটিসংশ্লিষ্টদের। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুল আলম ও সচিবালয়ের কেয়ারটেকার মাহমুদুর রহমান।

প্রতিবেদনটি প্রকাশের দিনই কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে চাকরিদাতা প্রতারক এ চক্রের মূল হোতা সচিবালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ফরাশ শাখায় (সকালে অফিসের তালা খোলা এবং বিকালে তালাবদ্ধের দায়িত্বে নিয়োজিত) কর্মরত মো. শফিকুল ইসলামকে। তবে ঘটনায় জড়িত অন্যতম প্রতারক সচিবালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী (অস্থায়ী) কেএম মোর্তুজা আলী রনি এখনো রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এ প্রতারকচক্রের মূলোৎপাটনে তদন্তে নেমেছে অপরাধ তদন্ত বিভাগও (সিআইডি)। চাকরিদাতা এ চক্রের বিরুদ্ধে গত ৩ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় একটি মামলা (নম্বর-১৩) করেছেন একেএম মোসলেহ উদ্দিন নামে প্রতারণার শিকার মিরপুরের এক বাসিন্দা। মামলায় আসামি করা হয়েছে সচিবালয়ে কর্মরত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মো. শফিকুল ইসলাম ও কেএম মোর্তুজা আলী রনি এবং তাদের সহযোগী দালাল মো. শাহিনুল কাদির সুমন ওরফে পালসার সুমনকে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিবের (প্রশাসন) স্বাক্ষর জাল করে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার চেয়ারে বসে, রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার্য খামে চাকরির ভুয়া নিয়োগপত্র দেওয়ার মাধ্যমে দুই চাকরিপ্রত্যাশীর কাছ থেকে ২৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার।

গত ২ আগস্ট চক্রের সদস্য পালসার সুমনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-৪। মামলাটি শুরু থেকে তদন্ত করছিল মিরপুর মডেল থানাপুলিশ। আমাদের সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পরদিন অর্থাৎ গত শুক্রবার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে এ মামলার তদন্তভার গ্রহণ করে সিআইডির ঢাকা মেট্রো পশ্চিম মিরপুর বিভাগ।

মামলার সাবেক তদন্তকারী কর্মকর্তা মিরপুর মডেল থানার এসআই রাসেল বলেন, চাকরি প্রদানের নামে প্রতারণাকারী এ চক্রের একাধিক সদস্য সচিবালয়ে কর্মরত বলে আমরা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছি। মামলাটির তদন্তভার গত শুক্রবার গ্রহণ করেছে সিআইডি।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের বাংলাদেশ সচিবালয়ের পিডব্লিউডি ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তফা কামাল গতকাল রবিবার আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশের দিনই ৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ১০ কর্মদিবস সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সেদিনই অভিযুক্ত সচিবালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ফরাশ শাখায় কর্মরত মো. শফিকুল ইসলামকে তার কর্মস্থল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গত ২ আগস্ট মিরপুরের সনি সিনেমা হলের সামনে থেকে এ প্রতারকচক্রের সদস্য শাহিনুল কাদির সুমন ওরফে পালসার সুমনকে র‌্যাব ৪-এর পরিদর্শক মো. আমির আলী ও উপপরিদর্শক মো. বাদল গোমস্তার নেতৃত্বে একটি আভিযানিক দল গ্রেপ্তার করে। র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে পালসার সুমন জানিয়েছেন, সংঘবদ্ধ এ প্রতারকচক্র রাজধানীসহ সারাদেশের প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষিত বেকার চাকরিপ্রত্যাশী যুবক-যুবতীদের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, রেল, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করে। চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে সারাদেশেই এভাবে প্রতারণার জাল বিছিয়েছে।

পালসার সুমন ও তার তিন সহযোগীর বিরুদ্ধে গত ২২ আগস্ট মাগুরার সদর আমলি (ক) আদালতেও একটি মামলা হয়। মামলাটি করেছেন জনৈক শাখাওয়াত হোসেন। বাদীর অভিযোগ, তার ছেলেসহ ৮ জনকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে অফিস সহকারী ও অফিস সহায়ক পদে চাকরি দেওয়ার নাম করে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় ৭৯ লাখ টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক উপসচিবের স্বাক্ষর জাল করে হুবহু নিয়োগপত্রের আদলে তাদেরও দেওয়া হয়েছিল ভুয়া ‘নিয়োগপত্র’।

গত বৃহস্পতিবার আমাদের সময়ে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অফিসের সময় শেষ হয়ে গেলে যখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সচিবালয় ছাড়েন, তখন তাদেরই কক্ষে শুরু হয় সংঘবদ্ধ এ প্রতারকদের ‘অফিস’! পোশাক-পরিচ্ছদ পরিবর্তন করে এসব প্রতারকের কেউ বনে যান সচিব-উপসচিব; কেউবা তাদের পিএ। কখনো উপসচিবের কক্ষে, কখনো যুগ্ম সচিবের কক্ষে- কর্মকর্তাদের চেয়ারে বসেই প্রতারকরা চাকরিপ্রার্থীদের ইন্টারভিউ নেওয়ার নামে নাটক করেন এবং বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি দেওয়ার নাম করে হাতিয়ে নিচ্ছেন মাথাপিছু ১০ থেকে ১৮ লাখ টাকা। বছরের পর বছর ধরে চলছে এহেন নাটক। এটি প্রতারণাই শুধু নয়, প্রশ্নবিদ্ধ করছে দেশের প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেও।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877