স্বদেশ ডেস্ক: আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ৭৮টি জেলার বেশিরভাগই চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিতে। দলের সর্বশেষ ২০তম জাতীয় সম্মেলনের পর জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম তেমন একটা দেখা যায়নি বললেই চলে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দায়িত্ব পাওয়ার পর ৭৮ জেলার মধ্যে মাত্র একটিতে সম্মেলন করতে পেরেছেন।
কয়েকটি উপজেলায় সম্মেলন করেছেন কয়েকজন দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক। দলটির নেতারা বলছেন, অক্টোবরে আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন হওয়ার কথা। এর আগে মেয়াদোত্তীর্ণ জেলাগুলোয় সম্মেলন অনিশ্চিত বলেই মনে করছেন তারা। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম টানা দুই মেয়াদে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকাকালে মেয়াদোত্তীর্ণ ও পুরনো জেলা কমিটিগুলো ঢেলে সাজান।
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এবং ৭ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ৭ সাংগঠনিক সম্পাদক, সভাপতিম-লী ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সারাদেশের প্রায় সব জেলায় ওই সময় সম্মেলন করে সৈয়দ আশরাফের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক টিম। তবে কয়েকটি জেলায় ওই সময়ও সম্মেলন হয়নি। কেন্দ্র থেকে কমিটি দিয়ে জেলাগুলোতে প্রাণের সঞ্চার করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে সৈয়দ আশরাফের স্থলাভিষিক্ত হন ওবায়দুল কাদের। তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পর বেশ কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যেই হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন ওবায়দুল কাদের। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ২ মাস ১০ দিন পর সিঙ্গাপুর থেকে সুস্থ হয়ে দেশে ফেরেন তিনি।
মূলত এসব নানা কারণেই মেয়াদোত্তীর্ণ জেলাগুলোতে সম্মেলন হয়নি বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা। গত প্রায় তিন বছরে ওবায়দুল কাদেরের আমলে মাত্র একটি জেলায় সম্মেলন হয়েছে। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, গঠনতন্ত্র অনুসারে আগামী অক্টোবরে শেষ হচ্ছে বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ। দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অক্টোবরেই জাতীয় সম্মেলন করবেন বলে জানিয়েছেন। তবে চোখের চিকিৎসার কারণে
প্রধানমন্ত্রী প্রায় তিন সপ্তাহ দেশের বাইরে থাকায় অনেকেই ভাবছেন সম্মেলন মাসখানেক পিছিয়ে যেতে পারে। দলটির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, সেপ্টেম্বরে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে জাতীয় সম্মেলনের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, নির্ধারিত সময়েই জাতীয় সম্মেলন হবে। তার মতে, অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সম্মেলন হতে পারে। জেলা সম্মেলনের বিষয়ে তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ওবায়দুল কাদেরের অসুস্থতা সব কিছু মিলিয়ে জেলা সম্মেলন হয়নি। এখন এগুলো হবে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সম্মেলনের দিন থেকে মেয়াদ গণনা শুরু করলে দলের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র একটি কমিটির মেয়াদ রয়েছে। বাকিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। আর পূর্ণাঙ্গ কমিটির সময় থেকে মেয়াদ গণনা শুরু করলে বেশ কয়েকটি জেলা কমিটির মেয়াদ প্রায় শেষদিকে, বাকিগুলোর মেয়াদ অতিক্রান্ত হয়েছে।
দলটির দুজন সাংগঠনিক সম্পাদকের মতে, জেলা কমিটির মেয়াদ কোনো বিষয় নয়। কারণ জেলা কমিটিগুলো সরাসরি আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনিটরিং করেন। তিনি নির্দেশ দেওয়া মাত্রই জেলা সম্মেলন করা সম্ভব। মূল সমস্যা হচ্ছে উপজেলা সম্মেলন নিয়ে। অনেক উপজেলায় ২০, ২৫ বছর মেয়াদি কমিটিও রয়েছে। এগুলো পুরনো বললে ভুল হবে, রীতিমতো জং ধরে গেছে। বেশকিছু উপজেলা আছে, যেগুলোয় শেষ কবে সম্মেলন হয়েছিল, এ তথ্যও নেই অনেকের কাছে। শুধু তা-ই নয়, উপজেলা কমিটির ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী রাজনীতিকরা। ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, নোয়াখালী, বরিশালের মতো জেলায় আওয়ামী লীগের একাধিক প্রভাবশালী নেতা রয়েছেন। এসব জেলায় উপজেলা পর্যায়ে সাংগঠনিক সমস্যাও বেশি। এসব জেলার কিছু কিছু এলাকায় ‘দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়’ হিসেবে দেখা হয়। এটি দলীয় শৃঙ্খলার জন্য একটা বড় সমস্যা।
জানা গেছে, ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুর ও শেরপুর জেলার সম্মেলন হয়েছে ২০১৫ সালে। আর ময়মনসিংহ জেলা ও মহানগর এবং নেত্রকোনায় ২০১৬ সালে সম্মেলন করেন তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। মিসবাহ উদ্দীন সিরাজ এ বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার পর ময়মনসিংহ জেলা ও মহানগর এবং নেত্রকোনা পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্র। বাকিগুলো আহমদ হোসেনের সময়কার কমিটি। এ বিভাগের বেশিরভাগ উপজেলায় সম্মেলন হয় না বহু বছর। সেপ্টেম্বর থেকে উপজেলা সম্মেলন করার আগ্রহ আছে মিসবাহ সিরাজের।
২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে রংপুর বিভাগের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, রংপুর মহানগর, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলার সম্মেলন করেন বিভাগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। অধিকাংশ উপজেলায় সম্মেলন শেষ করে জেলা সম্মেলন করেন তিনি। বর্তমানে এ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল। তিনি বলেন, রংপুর জেলার তিনটি উপজেলায় সম্মেলন করেছি। আগামী ১০, ১১, ১৪, ১৫, ২১ সেপ্টেম্বর আরও পাঁচটি উপজেলায় সম্মেলন হবে।
২০১৪ সালের শেষদিকে রাজশাহী জেলার জয়পুরহাট, বগুড়া, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, রাজশাহী মহানগর, নাটোর ও পাবনা জেলায় এবং ২০১৫ সালে সিরাজগঞ্জ জেলায় সম্মেলন করেন বিভাগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন। বর্তমানে এ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলা কমিটিগুলো আপডেট আছে। দু-একটা জেলা ছাড়া তেমন একটা সমস্যা নেই।
বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে সম্মেলন হয়েছে ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে। এ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম। তিনিই জেলাগুলোর সম্মেলন করেছেন।
ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোর সম্মেলন হয়েছে ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে। তবে এ বিভাগের গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে কেন্দ্র থেকে কমিটি দেওয়া হয়েছিল। এ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, জেলা কমিটির বয়স ৩ থেকে ৫ বছর ঠিক আছে। কারণ একটা ধারাবাহিক পরিবর্তন তো আসছে। আমাদের মূল সমস্যা উপজেলা পর্যায়ে। কোনো পরিবর্তন আসছে না। ঢাকা বিভাগে মাত্র ১৫ শতাংশ উপজেলা কমিটি ঠিক আছে, বাকি ৮৫ শতাংশ কমিটি বহুদিন আগের। এখন উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সম্মেলনের জন্য জেলা কমিটিগুলোকে তাগাদা দিচ্ছি আমরা।
বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির অধীনে একটিমাত্র জেলায় সম্মেলন হয়েছে, সেটা সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলায় ২০১৭ সালে। এ বিভাগের বাকি জেলা কমিটিগুলোর মেয়াদ অতিক্রান্ত হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, সম্মেলন একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়াÑ আজ হোক, কাল হোক হবেই। পার্টিকে গতিশীল রাখতে যথাসময়ে না হলেও পরে সম্মেলন করব।
চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোতে সম্মেলন হয়েছে ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে। কুমিল্লা মহানগর ও চট্টগ্রাম দক্ষিণে সম্মেলন ছাড়াই কমিটি হয়। বর্তমানে এ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম।
খুলনা বিভাগের কুষ্টিয়া ও খুলনা মহানগরে সম্মেলন হয়েছে ২০১৪ সালে। বাকি জেলাগুলোতে সম্মেলন হয়েছে ২০১৫ সালে। জানতে চাইলে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, যেসব জেলা কমিটির মেয়াদ অতিক্রান্ত হয়েছে, অচিরেই সেগুলোয় সম্মেলন হবে।