স্বদেশ ডেস্ক: জন সেয়ার্ল যখন নিজের স্মৃতি হারানো শুরু করলো, তখন তিনি ধারণা করেছিলেন যে এটি ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রম রোগের লক্ষণ। তবে পরে দেখা গেলো তিনি এমন এক বিরল রোগে আক্রান্ত যেটি অনেকসময় নির্ণয় করাই সম্ভব হয় না। তবে সুখবর হলো, এই নরমাল প্রেশার হাইড্রোসেফালাস থেকে চিকিৎসায় আরোগ্যলাভ সম্ভব।
কয়েকবছর আগেই জন সেয়ার্ল ভেবেছিলেন যে তার জীবনাবসানের সময় ঘনিয়ে এসেছে। তার শরীর ধীরে ধীরে কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছিল। তার হাঁটতে সমস্যা হচ্ছিল, ছোট ছোট জিনিস ভুলে যাচ্ছিলেন এবং সেসময় তার মলমূত্রের নিয়ন্ত্রণ হারানো শুরু করেন।
কানাডার অন্টারিও এলাকার সাবেক এই প্রকৌশলী এধরণের উপসর্গের সাথে খুব ভালভাবেই পরিচিত ছিলেন। তার বোন ৫০’এর কোঠায় মারা যান আলঝেইমারে। তার বাবাও ৮০ বছর হওয়ার পরপরই ডিমেনশিয়ায় মারা যান।
কাজেই তিনি এমন এক ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করা শুরু করেন যেখানে তার সজ্ঞান কোনো উপস্থিতি থাকবে না।
‘আপনি কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারেন সে বিষয়ে চিন্তা হওয়া শুরু করে তখন। মনে হতে থাকে, তাহলে কী এ পর্যন্তই?’
ডাক্তাররা নিশ্চিত করে তাকে কোনো ব্যাধির নাম বলতে পারেননি, যার ফলে ৬৯ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত এই ইঞ্জিনিয়ার আরো ক্রোধান্বিত হন। তার রোগে পার্কিনসন্সের চিকিৎসা করে কোনো ফল পাওয়া যায়নি, তার আলঝেইমারও ছিল না।
২০১৮ সালের মধ্যে ঘরের বাইরে যেতে তার হুইলচেয়ারের সাহায্য নিতে হতো। এমনকি ঘরের ভেতরে হাটতেও তার সাহায্যের প্রয়োজন হতো।
‘কোনো আশাই আর বাকি ছিল না। আমি প্রতিদিন জানালার পাশে বসে মৃত্যুর অপেক্ষা করতাম।’
তার স্ত্রী বারবারা বলেন, ‘তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে থাকতেন। এরকম অনেক রাত পার হয়েছে যখন আমার মনে হতো যে চিকিৎসার জন্য আমার হয়তো বাড়িটাও বিক্রি করতে হবে।’ তবে ডাক্তার আলফোনসো ফাসানসোর সাথে দেখা করার পর থেকেই অবস্থা পাল্টে যায়।
টরোন্টোর ওয়েস্টার্ন হাসপাতালের মুভমেন্ট ডিজঅর্ডার ক্লিনিকের নিউরোলজিস্ট মি. ফাসানসো তার মধ্যে নরমাল প্রেশার হাইড্রোসেফালাস বা এনপিএইচ রোগ শনাক্ত করেন। মস্তিষ্কের কোষগুলোতে – যেগুলো মানুষের যোগযোগের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে – যখন অতিরিক্ত পরিমাণ সেরিব্রোস্পাইনাল তরল জমা হয়, তখন এই সমস্যা তৈরি হয়।
এই তরল জমা হওয়ার ফলে নাড়াচাড়ায় জটিলতা, স্মৃতি ও চেতনানাশ হওয়ার সম্ভাবনার পাশাপাশি মলমূত্রের নিয়ন্ত্রণ রাখতেও সমস্যা তৈরি হয়। আলঝেইমার, পার্কিনসন্স বা ডিমেনশিয়ার মত পরিচিত ক্ষয়িষ্ণু রোগের ক্ষেত্রেও একই ধরণের উপসর্গ দেখা যায়।
হাইড্রোসেফালাস ক্যানাডা নামের একটি সংস্থার ধারণা অনুযায়ী সেদেশে ৫৫’র বেশি বয়সী প্রতি ২০০ জনে একজনের, অর্থাৎ সারাদেশে ৫৭ হাজারের বেশি মানুষের এনপিএইচ রোগ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের হাইড্রোসেফালাস অ্যাসেসিয়েশনের মতে সেখানে ৭ লাখ আমেরিকান এই রোগের ভুক্তভোগী হলেও তাদের মাত্র ২০ ভাগের রোগ নির্ণয় সঠিকভাবে করা হয়েছে।
ডাক্তার ফাসানো বলেন, ‘এনপিএইচ এমন একটি অবস্থা যেটিকে এখনও পরিপূর্ণভাবে বোঝা সম্ভব হয়নি।’ তার মতে চিকিৎসা না করা হলে এই রোগে মানুষ বছরের পর বছর নার্সিং হোমে পড়ে থাকতে পারে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে জটিলতা তৈরি হলে মারাও যেতে যারে।
২০০৩ সালে মাইগ্রেনের চিকিৎসা করার সময় প্রথমবার এই রোগের নাম জানতে পারেন মি. সেয়ার্ল। এমআরআই করার পর জানা যায় যে তার মস্তিষ্কের প্রকোষ্ঠে কিছু তরল জমা হয়েছে, কিন্তু অন্যান্য পরিচিত উপসর্গ না থাকায় তার রোগ নির্ণয় করা হয়নি।
এরপর দীর্ঘসময় হাঁটাচলা করতে সমস্যা এবং স্মৃতিভ্রম হওয়ার পর ২০১৪ সালে ডাক্তাররা তার মস্তিষ্কের কিছু তরল বের করে দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন যে তার অবস্থার উন্নতি হয় কিনা। সেয়ার্লের অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ডাক্তাররা ধরে নেন যে এটি হয়তো এনপিএইচ নয়।
এর কয়েকবছর পর তার শরীরের অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকলে তিনি ডা. ফাসানোর সাথে দেখা করে আবারো টেস্ট করার সিদ্ধান্ত নেন।
এবার তার স্ত্রী বারবারা তার মধ্যে কিছু ছোটখাটো উন্নতি লক্ষ্য করেন। আর সেই পরিবর্তনগুলো এতই সামান্য ছিল যে তার স্বামী নিজেও সেগুলো লক্ষ্য করেননি।
বারবারা বলেন, ‘আমার স্বামী বিশ্বাসই করেনি যে তার অবস্থার কোনো উন্নতি হয়েছে। তার মনে ভয় ছিল যে ‘আমি যদি বিশ্বাস করে শেষে দেখি যে আসলে উন্নতি হয়নি, তাহলে অতিরিক্ত হতাশ হয়ে যাবো।’ ডা. ফাসানো তার মাথার ভেতর থেকে সরাসরি তরল বের করে আনার পদ্ধতি অবলম্বন করার পরামর্শ দেন। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী এনপিএইচের চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিই সবচেয়ে বেশি কার্যকর।
এক বছরেরও বেশি সময় বাদে বর্তমানে নিজের পুরনো জীবন ফিরে পেতে শুরু করেছেন বলে মন্তব্য করেন সেয়ার্ল। তার স্মৃতির পাশাপাশি চলাফেরার ক্ষেত্রেও উন্নতি হয়েছে।
জিমে ব্যক্তিগত প্রশিক্ষক নিয়ে নিয়মিত শরীরচর্চা করেন তিনি, শরীরের জোর ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে প্রতিদিন হাঁটতেও বের হন। ‘অস্ত্রোপচার চিকিৎসার কেবল ৫০%, বাকিটা আপনার মানসিকতা’, বলেন সেয়ার্ল। সেয়ার্ল ও তার স্ত্রী একসাথে ভ্রমণ করাও শুরু করেছেন।
গত শীতে তারা ফ্লোরিডা গিয়েছিল এবং লাস ভেগাস ও জ্যামাইকা যাওয়ার পরিকল্পনাও করছেন। তার স্ত্রী বারবারা বলছেন সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে তার স্বামীর মেজাজে।
‘যেই বিষন্নতা তাকে গ্রাস করেছিল সেটি একেবারেই নেই। তিনি আবারও আগের মত হাসিখুশি হয়েছেন।’
ডা, ফাসানসো জানান সেয়ার্লের গল্প গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে, আর তারপর থেকেই ক্লিনিকে বিপুল সংখ্যক রোগী যোগাযোগ করেছেন যারা মনে করেন যে তাদের এনপিএইচ আছে এবং এর আগে যাদের ভুলভাবে চিকিৎসা করা হয়েছে। এনপিএইচ ভুলভাবে নির্ণয় করার সমস্যাটি অনেক জায়গাতেই হয়ে থাকে।
তবে ডা. ফাসানসো মনে করেন পার্কিনসন্স বা আলঝেইমারওরোগের ক্ষেত্রেও সঠিক রোগ নির্ণয় হওয়া খুবই জরুরি, বিশেষ করে নিউরোলজিস্টদের দ্বারা যদি তাদের চিকিৎসা হয়ে থাকে।
জাপানের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৬৫ বছরের বেশি বয়সী জনসংখ্যার প্রায় ৩ ভাগের এনপিএইচ রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান অনুযায়ী ডিমেনশিয়ায় ভোগেন ৬০ বছরের বেশি বয়সী জনসংখ্যার ৫ থেকে ৮ শতাংশ।
ডাক্তার ফাসানসো বলেন, ‘আমরা যতটা মনে করি, এই রোগের বিস্তৃতি তার চেয়েও অনেক বেশি। আর এই রোগের চিকিৎসা করও সম্ভব। চিকিৎসার পর রোগীদের জীবনে নাটকীয় পরিবর্তনও আনা সম্ভব।’