একজন মানুষের মু’মিন হওয়ার জন্য যেসব বিষয়ের প্রতি ঈমান আনা অত্যাবশ্যক, তার মধ্যে একটি হলো আখেরাত বা পরকালে বিশ্বাস। পবিত্র কুরআনুল কারিমের অনেক আয়াতে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিভিন্ন হাদিসে ঈমান বিল্লাহ (আল্লাহর প্রতি ঈমান)-এর পর ঈমান বিল আখিরাহ (পরকালে বিশ্বাস)-এর কথা উল্লিখিত হয়েছে। তাওহিদ ও রিসালাতে বিশ্বাস যেমন ঈমানের অবিচ্ছিন্ন অংশ, পরকালে বিশ্বাসও তেমনি ঈমানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
পরকালের প্রতি ঈমান আনয়নের অর্থ হলো, ‘মহান আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম ঘোষিত এ মহাসত্য স্বীকার ও বিশ্বাস করে নেয়া যে, ইহজাগতিক ক্ষণস্থায়ী জীবনের পর আরেকটি অনন্তকালীন জীবন অবশ্যম্ভাবী। যে জীবনে প্রতিটি মানুষকে তার ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, ন্যায্য-অন্যায্য এবং উৎকৃষ্ট ও নিকৃষ্ট যাবতীয় কৃতকর্মের পুরস্কার ও শাস্তি ভোগ করতে হবে।’ পরকালের প্রতি ঈমান বা বিশ্বাসের এটাই মূলকথা।
বস্তুত পরকাল সম্পর্কে এতটুকু মৌলিক কথা তো সহজে অনুধাবন করা যায়, ইহকালীন এ জীবনের পর আরেকটি এমন জীবন অবশ্যই থাকা অতি প্রয়োজন, যেখানে প্রতিটি মানুষ তার কৃতকর্মগুলোর যথাযোগ্য পুরস্কার বা শাস্তি প্রাপ্ত হবে।
কারণ পৃথিবীতে আমরা দেখতে পাই, অসংখ্য মানুষ তার গোটা জীবনে জঘন্য থেকে জঘন্যতম গুনাহ-পাপাচার, অন্যায়-অনাচার ও পাপ-পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত থাকে। চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানি, খুনখারাবি-হত্যাকাণ্ড ঘটানোসহ বহুবিধ অনৈতিক ও সামাজিক অপরাধে লিপ্ত হয়। নিঃস্ব-দরিদ্র ও দুর্বল-অসহায়ের রক্ত শোষণ করে, সুদ-ঘুষ ও অবৈধ পথে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে, মানুষের ওপর জুলুম-অত্যাচার ও নির্যাতন-নিপীড়ন চালায়, অপরের জীবন-সম্পদ ও মান-মর্যাদা বিনষ্ট করতে কুণ্ঠিত হয় না। এভাবে সমগ্র জীবন সে স্বেচ্ছাচারিতাপূর্ণ ভোগ-বিলাস ও উদগ্র আরাম-আয়েশে কাটিয়ে একসময় মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
আবার অনেক মানুষকে দেখা যায়, তারা অত্যন্ত সততা ও ন্যায়-নিষ্ঠাপূর্ণ জীবন যাপন করে, কারো প্রতি অত্যাচার-অবিচার করে না, কারো সাথে ধোঁকা-প্রতারণার আশ্রয় নেয় না, কারো অধিকার বিনষ্ট করার চিন্তা করে না, অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের কল্পনা তাদের মাথায় আসে না। তারা সদা আল্লাহ তায়ালার ইবাদত-বন্দেগিতে ব্যাপৃত থাকে এবং আর্তমানবতার সেবা তথা জনকল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত হওয়াকে নিজের জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয় মনে করে। অথচ তাদের কাউকে কাউকে জীবন কাটাতে হয় অভাব-অনটনে, দুঃখ-কষ্টে ও সমস্যা-সঙ্কটে। কখনো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, কখনো কঠিন বিপদাপদে নিপতিত হয়, আবার কখনো দুঃখ-দুর্দশায় জর্জরিত হয়। অবশেষে এ অবস্থায়ই পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেয়।
সুতরাং পৃথিবী আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি এবং তিনিই মানুষের ভালো-মন্দ সব কৃতকর্মের সম্মুখদ্রষ্টা। অথচ আমরা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করছি, পৃথিবীতে সৎকর্মপরায়ণ লোকেরা তাদের সততা ও সৎকর্মের যথাযথ পুরস্কার প্রাপ্ত হয় না। আর না অসৎ লোকেরা তাদের অসততা ও অসৎ কর্মের যথোপযুক্ত শাস্তির সম্মুখীন হয়। তাহলে অবশ্যই বুঝতে হবে, সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে এ পুরস্কার ও শাস্তি, শুভ ও অশুভ পরিণতি মানুষকে অবধারিতভাবে অন্য কোনো জগতে ভোগ করতে হবে। এটা তো হতে পারে না, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তাঁর সৎ বান্দাদেরকে তাদের সততার পুরস্কার দেবেন না এবং অসৎ বান্দাদেরকে অসততার শাস্তি দিবেন না। সৎ-অসৎ, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট নির্বিশেষে সব মানুষের সাথে আল্লাহ অভিন্ন আচরণ করবেন- এটা যৌক্তিক ও বিবেকসম্মত নয়। কারণ আল্লাহ তায়ালার মহাসত্তা সবধরনের জুলুম-নিপীড়ন, অবিচার-অনাচার ও স্বেচ্ছাচারিতা থেকে পবিত্র মহান।
খালিকুল কায়েনাত (বিশ্বজাহানের স্রষ্টা) আল্লাহ তায়ালা তো দূরের বহু দূরের কথা, পৃথিবীর কোনো সভ্য সমাজেও কল্পনা করা যায় না যে, সেখানে উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট, সৎ-অসৎ, জালিম-মজলুম এবং নিপীড়িত-নিপীড়কের সাথে অভিন্ন আচরণ করা হবে। পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে : ‘এটা কি হতে পারে, আমি আত্মসমর্পণকারী ও অপরাধীদের সাথে অভিন্ন আচরণ করব?’ (সূরা কালাম, আয়াত : ৩৫)
মোটকথা, পৃথিবীতে যখন মানুষের ভালো-মন্দ, সৎ-অসৎ কৃতকর্মগুলোর যথাযথ পরিণাম বা ফল সংঘটিত হচ্ছে না, তখন এ কথা অনিবার্যরূপে সাব্যস্ত হয়ে যায়, ইহকালীন ক্ষণস্থায়ী জীবনের পর আরেকটি চিরস্থায়ী অনন্ত জীবন অবশ্যই সমাগত হবে, যেখানে প্রতিটি মানুষকে তার ভালো-মন্দ কৃতকর্মগুলোর যথাযথ পরিণাম ভোগ করতে হবে।
আখেরাত বা পরকাল আবশ্যক হওয়ার বিষয়টি এভাবেও বোঝা যেতে পারে, পৃথিবীতে প্রতিটি বস্তুরই বিশেষ কোনো ক্রিয়া এবং প্রতিটি ক্রিয়ারই বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যেমন, পানির বৈশিষ্ট্য নির্বাপিত করা, আগুনের বৈশিষ্ট্য দহন করা, ওষুধের বৈশিষ্ট্য নিরাময় করা এবং খাবার-পানীয় গ্রহণের বৈশিষ্ট্য ক্ষুধা-পিপাসা নিবারিত হওয়া। অনুরূপ মানুষের প্রতিটি জৈব কর্মকাণ্ডেরও কিছু বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব রয়েছে, যা অনিবার্যভাবে প্রকাশিত হয়। যেমন, খাবার-পানীয় গ্রহণে ক্ষুধা-পিপাসা নিবারিত হয়, শক্ত-কঠিন বস্তু ভক্ষণে পেটে ব্যথা হয়, প্রয়োজনাতিরিক্ত আহারে বদহজম হয়, বিষপানে মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়, ওষুধ সেবনে রোগ নিরাময় হয় এবং শক্তিবর্ধক ওষুধ গ্রহণে দৈহিক শক্তি অর্জিত হয়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, একজন মানুষের উপরোক্ত জৈব কর্মকাণ্ডগুলোর তুলনায় তার ভালো-মন্দ নৈতিক কর্মকাণ্ড ও আচরণ-উচ্চারণগুলোর গুরুত্ব বহুগুণ বেশি। সুতরাং নৈতিক কর্মকাণ্ড ও আচরণ-উচ্চারণগুলোর কোনো প্রভাব, প্রতিক্রিয়া ও পরিণতি থাকবে না, এটা কিছুতেই যুক্তিসঙ্গত কথা নয়। যেমন, কেউ নিজে ক্ষুধার্ত থেকে অপর ক্ষুধার্তকে আহার দান করল, নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দান করল, অসহায় রোগীর শুশ্রুষায় নিয়োজিত হলো, ইয়াতিম-গরিব ও বিধবার তত্ত্বাবধানে এগিয়ে এলো এবং নিজের কষ্টার্জিত অর্থ তাদের পেছনে অকাতরে ব্যয় করল। অধিকন্তু সে আপন মাবুদে হাকিকি সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগি এবং তার আদেশ-নিষেধ পালনে নিরত থাকল, তাহলে বিবেক-যুক্তি ও বাস্তবতার দাবি এটাই যে, তার এ মহৎ কর্মগুলোর যথাযথ বিনিময় ও শুভ পরিণামফল অবশ্যই সে প্রাপ্ত হবে।
পক্ষান্তরে যদি কেউ জুলুম-অত্যাচার করে, অনুগত ও দুর্বলদের অধিকার বিনষ্ট করে, আমানতে খেয়ানত করে, ব্যবসাবাণিজ্যে ধোঁকা-প্রতারণার আশ্রয় নেয়, সুদ-ঘুষ ও অসদুপায় অবলম্বনে দ্বিধা করে না, চুরি-ডাকাতি ও ছিনতাই-রাহাজানিতে লিপ্ত হয়, নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটানোর মাধ্যমে মানুষের রক্ত প্রবাহিত করে; সে আল্লাহ তায়ালার ইবাদাত-বন্দেগি করবে তো দূরের কথা নিজ পালনকর্তার নাম ভুলেও উচ্চারণ করে না। এ ধরনের ব্যক্তি সম্পর্কে বিবেকবান যে কেউ বলতে বাধ্য হবে, তার এ জঘন্য দুষ্কর্মগুলোর শাস্তি ও পরিণতিও অত্যন্ত কঠিন হওয়া যুক্তিসঙ্গত, যা তাকে একদিন অবশ্যই ভোগ করতে হবে। কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে :
‘যারা দুষ্কৃতি ও পাপকর্মে লিপ্ত হয়েছে তারা কি মনে করে, আমি তাদেরকে সেই সৎ লোকদের অনুরূপ করব, যারা ঈমান আনয়ন করেছে ও সৎকর্ম করেছে এবং তাদের পরিণতি ও জীবন-মৃত্যু এক সমান হবে? তাদের সিদ্ধান্ত কত নিকৃষ্ট!’ (সূরা জাসিয়া, আয়াত : ২১)
মোটকথা, আমরা যখন পৃথিবীতে স্বচক্ষে দেখছি, মানুষের বাহ্যিক ও জৈবিক যাবতীয় কর্মকাণ্ডের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া ইহজগতে প্রকাশিত হচ্ছে; অথচ তার আত্মিক ও নৈতিক আমল ও কর্মগুলোর বিশেষ কোনো প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া পৃথিবীতে প্রকাশিত হচ্ছে না। তাহলে আমাদের বিবেক ও চিন্তা, আমাদের অনুভ‚তি ও বাস্তবতাবোধ এ সিদ্ধান্ত দিতে বাধ্য যে, ইহকালীন এ জীবনের পর অবশ্যই আরেকটি এমন জীবন অবশ্যম্ভাবী, যেখানে প্রতিটি মানুষের নৈতিক ও আত্মিক যাবতীয় কৃতকর্মের প্রতিফল ও পরিণতি প্রকাশিত হবে এবং প্রত্যেকে আপন আপন ভালো-মন্দ কর্মফল বুঝে পাবে। আর ওই জীবনই হলো আখেরাত বা পরকালীন জীবন। যে জীবনের শুরু আছে সমাপ্তি নেই। অনন্তকালব্যাপী সেই জীবনের অস্তিত্ব স্বীকার করা ঈমানের একটি অলঙ্ঘনীয় অংশ।
প্রশ্ন হতে পারে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে পুরস্কার ও শাস্তি প্রয়োগে পৃথিবী কি যথেষ্ট ছিল না! এ জন্য অনন্তকালীন আরেকটি জীবনের আবার কী প্রয়োজন ছিল? বস্তুত পৃথিবী পুরস্কার ও শাস্তির প্রয়োগক্ষেত্র না হওয়ার অন্তর্নিহিত রহস্য হলো, মানুষের ভালো-মন্দ কৃতকর্মের পরিণাম ফল যদি ইহজগতেই হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবীর পার্থিব জীবন মানুষের জন্য পরীক্ষার জীবন থাকবে না। অথচ আল্লাহ তায়ালা পার্থিব জগৎ সৃষ্টি করেছেন পরীক্ষাগাররূপে। আর পুরস্কার ও শাস্তি তথা জান্নাত ও জাহান্নাম দৃষ্টির অন্তরালে রেখে দিয়ে নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে তিনি জগদ্বাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন, যারা পৃথিবীতে আল্লাহর নিরঙ্কুশ আনুগত্য করবে, তাঁর আইন ও বিধান মেনে চলবে এবং উৎকৃষ্ট ও সৎ জীবন যাপন করবে, তাদের তিনি অনাগত পরকালীন জীবনে জান্নাত ও জান্নাতের অফুরন্ত নিয়ামত দ্বারা পুরস্কৃত করবেন। আর যারা আল্লাহর প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শন করবে, তাঁর আইন ও বিধান লঙ্ঘন করবে এবং পাপ-পঙ্কিলতাপূর্ণ জীবন যাপন করবে, তাদের তিনি জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন, জাহান্নামের কঠিন শাস্তি তাদের আস্বাদন করাবেন।
অতএব, মানুষের ভালো-মন্দ কৃতকর্মের ফলাফল ইহজীবনেই প্রকাশিত হয়ে গেলে তা মানবজাতির জন্য পরীক্ষাগার হবে কিভাবে? তাহলে তো মানুষ আল্লাহর নাফরমানি-অবাধ্যতা ও অন্যায়-অনাচার থেকে ঠিক তেমনি আত্মরক্ষা করবে, যেমন আত্মরক্ষা করে সে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়া থেকে বা অথৈ সাগরে তার সলিল সমাধি ঘটা থেকে। যেকোনো সৎকর্ম সম্পাদনে সে তেমনি বাধ্য হবে, যেমন বাধ্য হয় সে জীবন রক্ষায় আহার্য ও পানীয় গ্রহণে। আর তখন নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক ঘোষিত জান্নাত ও জাহান্নাম তথা চিরন্তন পুরস্কার ও শাস্তি অর্থহীন হয়ে পড়বে।
লেখক : মাদরাসা শিক্ষক