রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৭:০৮ পূর্বাহ্ন

কেলেঙ্কারি ফাঁস হয় শাস্তির খবর নেই

কেলেঙ্কারি ফাঁস হয় শাস্তির খবর নেই

স্বদেশ ডেস্ক:

ভিক্ষুকমুক্ত জেলা গড়তে গিয়ে বিভিন্ন মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন জামালপুরের সদ্য সাবেক হওয়া জেলা প্রশাসক (ডিসি) আহমেদ কবীর। সততার জন্য এ বছরই পেয়েছিলেন বিভাগীয় ‘শুদ্ধাচার পদক’। কিন্তু সবই গেছে নারী অফিস সহায়কের সঙ্গে আপত্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর। গতকাল রবিবার তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে ন্যস্ত করা হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। ডিসি কবীরের এ অনৈতিক কা-ের পর কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, প্রশাসনে এমন ঘটনা নতুন নয়, নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না দিতে পারলেও তা দিন দিনই বাড়ছে বলে তাদের ভাষ্য। ঘটনা জানাজানি হলে অভিযুক্তদের কেবল ওএসডি করা হয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে কী শাস্তি হয়, সেটি আর জানা যায় না। তবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে অনাকাক্সিক্ষত এসব ঘটনা কমে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
গত বৃহস্পতিবার রাতে খন্দকার সোহেল আহমেদ নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে ৪ মিনিট ৫৮ সেকেন্ড ও ২৪ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডের দুটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যাতে ডিসি আহমেদ কবীরকে এক নারীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখা যায়। ভিডিও প্রকাশের পর থেকেই

বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। তবে শুক্রবার সকাল থেকে ওই আইডিতে তা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। যদিও ততক্ষণে মেসেঞ্জারে ভাইরাল হয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে। ৪ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে ধারণ করা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ও ৩ আগস্টের। ডিসি কবীর অবশ্য নিজেকে নির্দোষ দাবি করে এ ঘটনাকে বানোয়াট বলছেন। বিপর্যস্ত কবীর ভিডিওর বিষয়ে বলেন, ‘এটি একটি সাজানো ভিডিও। একটি হ্যাকার গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরেই নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে আমাকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করলেও গুরুত্ব দেইনি। এর পরই বানোয়াট ভিডিওটি একটি ফেক আইডি থেকে পোস্ট দেওয়া হয়েছে।’ তবে ভিডিওতে দেখানো কক্ষটি অফিসের ভেতরে তার বিশ্রামাগার এবং ওই নারী নিজ কার্যালয়ের অফিস সহায়ক বলে স্বীকার করেন তিনি।
আপত্তিকর আচরণের ঘটনায় আহমেদ কবীরের শুদ্ধাচার সনদ কেড়ে নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। এদিকে ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন অধিশাখা) ড. মুশফিকুর রহমানকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। আগামী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে কমিটিকে। ঘটনা তদন্তে আরও থাকছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি, ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনারের একজন প্রতিনিধি, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) একজন প্রতিনিধি। তবে সদস্যরা কেউ উপসচিব পদমর্যাদার নিচে হতে পারবেন না।
প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘সরকারি চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী আহমেদ কবীরের বিরুদ্ধে উদাহরণ সৃষ্টির মতো শাস্তি হবে। অন্য কোনো কর্মকর্তাও যদি এসব অনৈতিকতায় জড়ান, তাদেরও ছাড় দেওয়া হবে না।’
সচিবালয় সূত্র জানায়, প্রশাসনে যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনা নতুন কিছু নয়। এর আগেও বহুবার এমন অভিযোগে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ওএসডি হয়েছেন। তবে বিভাগীয় মামলায় তারা যে খুব বেশি শাস্তি পেয়েছেন, এমন কোনো রেকর্ড নেই। গেল নভেম্বরেই ফেসবুকের মাধ্যমে নাটোরের এক নারী ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে অশোভন আচরণ, খারাপ প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ডিসি গোলামুর রহমানের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী নারী ম্যাজিস্ট্রেট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রতিকার চেয়ে গত ২৪ অক্টোবর আবেদন করে বলেন, তিনি ৩৪তম বিসিএসের একজন কর্মকর্তা। গত ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে নাটোরে কর্মরত। জেলা প্রশাসক গোলামুর রহমান চলতি বছরের ৯ অক্টোবর নাটোরে যোগ দেন। এর পর পরই তিনি তাকে সাধারণ ও ট্রেজারি শাখা থেকে সংস্থাপন শাখায় বদলি করেন। পরে সংস্থাপন শাখায় রক্ষিত সব কর্মকর্তার ব্যক্তিগত নথি নিয়ে ডিসি তাকে সার্কিট হাউসে অথবা ডাক বাংলোয় একান্তে সাক্ষাৎ করতে বলেন। এ ছাড়াও যোগদানের তিন দিন পর থেকেই ডিসি তার ফেসসবুক মেসেঞ্জারে যুক্ত হয়ে কথা বলতে থাকেন। প্রায়ই মেসেজ পাঠাতেন গভীর রাতে। কিন্তু উত্তর না দিলে পরের দিন সকালে কারণ ব্যাখ্যা করতে বলতেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৫ অক্টোবর জেলা প্রশাসক তাকে চরম বাজে ও আপত্তিকর প্রস্তাব দেন।
প্রশাসনের কর্মচারীদের মারধরসহ বিভিন্ন অভিযোগও ওঠে ডিসি গোলামুর রহমানের বিরুদ্ধে। পরে তাকে ওএসডি করা হয়। গোলামুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে সুপারিশও করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। বিষয়টি এখনো তদন্তের মধ্যেই পড়ে আছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মনোজ কান্তি বড়াল। নারায়ণগঞ্জের ডিসি থাককালীন তাকে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ার একাটি বাড়িতে প্রায় চার ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। অভিযোগ, ওই বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে অসামাজিক কার্যকলাপের উদ্দেশ্যে তিনি গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে।
কয়েক মাস আগে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বিরুদ্ধে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অভিযোগ জানান এক নারী। অভিযোগে বলা হয়, ওই ইউএনও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছেন। ফলে তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন। বিষয়টি জানার পর তাকে গর্ভপাত করতে চাপ দেন ইউএনও। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এখনো ঘটনাটি তদন্ত করছে। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব আমাদের সময়কে বলেন, ‘ইউএনওর ঘটনাটি তদন্তের শেষ পর্যায়ে। আমরা দ্রুত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করে প্রতিবেদন দেব।’
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নারী কেলেঙ্কারি ও শাস্তির প্রসঙ্গে কথা বলতে ফোন করা হলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সা’দত হুসাইন বলেন, ‘বিষয়টি খুবই সেনসেটিভ। মোবাইল ফোনে এ নিয়ে কথা বলব না।’ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে সাড়া দেননি।
রাতেই জামালপুর ছাড়লেন ডিসি : ওএসডির আদেশ আসার আগেই জনরোষ আতঙ্কে রাতের আঁধারে জামালপুর ছেড়েছেন বির্তকিত ডিসি আহমেদ কবীর। বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থায় শনিবার রাত ৩টায় তিনি জামালপুর ত্যাগ করে ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে আশ্রয় নেন। আলোচিত নারী অফিস সহকারীও গতকাল কর্মক্ষেত্রে যোগ দেননি বলে জানান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাজিব কুমার সরকার। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনাÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছি।’ এদিকে জামালপুরের নতুন ডিসি হয়েছেন মোহাম্মদ এনামুল হক।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877