স্বদেশ ডেস্ক:
বর্তমান সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর প্রচার থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন বিএনপির দুই নেতা। তবে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য কাওছার জামান এখনো মাঠে রয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে লড়বেন বলে জানিয়েছেন তিনি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে নীরব প্রচার চালাচ্ছেন মহানগর জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক মাহাবুবার রহমান বেলাল। জাতীয় পার্টি থেকে আগভাগেই প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ায় সরব প্রচারে রয়েছেন বর্তমান সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা।
তবে প্রার্থী চূড়ান্ত না হওয়ায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে স্নায়ুচাপ বেড়েছে। এ ছাড়া জাসদ (ইনু), বাসদ, ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিশসহ কয়েকটি দলের নেতারাও মেয়র পদের জন্য প্রচার চালাচ্ছেন। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশ প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে বিএনপি দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় কাওছার জামান বাবলা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাব। দলীয় সমর্থন না পেলেও আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব। তবে দলীয় সমর্থনের জন্য সোমবার দলীয় শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় যাচ্ছি।’
মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শামসুজ্জামান সামু বলেন, ‘সিটি নির্বাচনে আমাদের প্রার্থী ছিল। কিন্তু এ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। সে কারণে দলীয় সিদ্ধান্তে আমরা এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব না।’
এ অবস্থায় শেষ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ভোটযুদ্ধে থাকলে নির্বাচনকে ঘিরে তৈরি হতে পারে নতুন মেরুকরণ। প্রতিদ্বন্দ্বিতার লড়াইয়ে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে বেকায়দায় ফেলতে স্বতন্ত্র বেশে মাঠে নামা জামায়াতে ইসলামীর ভোটের সংখ্যা বাড়াতে পারে বিএনপি। যদিও জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী নিয়ে চিন্তিত নন সরকারি ও বিরোধী দল।
জামায়াতে ইসলামীর রংপুর মহানগরের সাবেক আমির অধ্যাপক মাহাবুবার রহমান বেলাল বলেন, ‘আমি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও সিটি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করব। খুব দ্রুত আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারে নামব। আশা করি, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমি বিজয়ী হব।’ বিএনপি যখন এই সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে, তখন জোটের নেতা হয়েও কেন প্রার্থী হবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি নাগরিক সমাজের মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে প্রার্থী হব। এটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন, এ নির্বাচন জাতীয় নির্বাচন নয়। আমি ইতোমধ্যে মেয়র পদে নির্বাচন করার ব্যাপারে ভালো সাড়া পাচ্ছি।’
নির্বাচক বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৭ সালে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ৩৭ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। এবার বিএনপি এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে তাদের সব ভোট পড়বে জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে। বিএনপির ছায়া সমর্থন নিয়ে জামায়াত এগিয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া রংপুরে জামায়াতের নিজস্ব ভোট ব্যাংক রয়েছে। ফলে নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ফ্যাক্টর হতে পারেন বলে অনেকে মনে করছেন। আবার কারও মতে, জাতীয় পার্টিতে জামায়াত-শিবির অনুসারী অনেক নেতাকর্মী রয়েছেন। তাদের একটি অংশের ভোটও জামায়াতের পক্ষে যেতে পারে।
অন্যদিকে জাতীয় পার্টি প্রার্থী চূড়ান্ত করলেও তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটেনি। এখনো লাঙল নিয়ে টানাটানি চলছে। বর্তমান মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফাকে মনোনয়ন দিয়ে রেখেছেন দলীয় চেয়ারম্যান জিএম কাদের। গত রবিবার রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি ও বর্তমান মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফাকে পার্টির প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত মনোনয়ন প্রদান করা হয়।
তবে দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের কাছ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন দাবি করে লাঙল প্রতীকের ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুন সাঁটিয়ে প্রচার চালিয়েছেন সাবেক পৌর মেয়র একেএম আবদুর রউফ মানিক। তবে তার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে তিনি দেশ ছেড়ে আমেরিকায় অবস্থান করছেন। দলের এমন টানাপড়েন আর দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে আপাতত নির্বাচন করবেন না বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি রওশন এরশাদের দেশে ফেরার দিকে তাকিয়ে আছেন। তবে নির্বাচন না করার সম্ভাবনাই বেশি বলে সূত্রে জানা গেছে। বর্তমানে আবদুর রউফ মানিক কিংবা তার কোনো সমর্থকের তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না।
এখন পর্যন্ত জাতীয় পার্টির একক প্রার্থী হিসেবে মাঠে সরব থাকা বর্তমান মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, ‘ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। বিশেষ করে বর্ধিত এলাকার রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করা হয়েছে। নগরবাসীর ব্যাপক সমর্থনে গত সাড়ে চার বছরেরও বেশি সময় ধরে সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সঙ্গে নাগরিক সেবা এবং কল্যাণে সার্বক্ষণিক সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছি। আশা করছি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে আবারও আমি নির্বাচিত হব।’
এদিকে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী কে হবেন, তা এখনো দলীয়ভাবে চূড়ান্ত হয়নি। এর মধ্যে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন অর্ধডজন নেতা। নৌকা পেতে চান রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাফিউর রহমান সফি, সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি ম-ল, রংপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম, কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইঞ্জিনিয়ার লতিফুর রহমান মিলন, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আতাউর জামান বাবু ও রংপুর মহানগর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মজিদ। তারা নগরীজুড়ে দোয়া কামনা করে ব্যানার-ফেস্টুন লাগিয়েছেন। সভা-সমাবেশেও যোগ দিচ্ছেন। এ ছাড়া নগরীতে পোস্টার-ফেস্টুন না সাঁটালেও লোকমুখে আছে আরও দুজনের নাম। তারা দলের হাইকমান্ডের দিকে তাকিয়ে আছেন। তারা হলেন- কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান ও রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম রাজু।
তফসিল ঘোষণার আগের দিন ৬ নভেম্বর পর্যন্ত নিজেদের সর্বোচ্চ শক্তিমত্তা প্রদর্শনের আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। সম্প্রতি নগরজুড়ে নৌকা তোরণ নির্মাণের পর ১০০ পিকআপের নৌকা র্যালির শোডাউন দিয়ে দলের হাইকমান্ডের দৃষ্টি কাড়ার চেষ্টা করেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি ম-ল। অন্যদিকে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে পাড়া-মহল্লায় শত শত সভা-সমাবেশ করেছেন রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাফিউর রহমান সফি। এবার তিনি সুপরিকল্পিত উন্নয়ন করতে রংপুর সিটিতে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন আশা করছেন। গত ৬ নভেম্বর রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে তিনি নাগরিক সমাবেশ করেছেন।
জানা গেছে, রবিবার রংপুর মহানগরীর বেতপট্টিতে দলীয় কার্যালয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় নৌকা প্রতীকের মনোনয়নের জন্য দলের মনোনয়ন বোর্ডে কয়েকজন প্রার্থীর নাম পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। ২০ নভেম্বর এ মনোনয়ন বোর্ড বৈঠকে বসবে। বর্ধিতসভায় সিদ্ধান্ত হয়- মনোনয়ন বোর্ড যাকে মেয়রপ্রার্থী মনোনীত করবে তার পক্ষেই সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে।
অন্যদিকে জাসদের (ইনু) প্রার্থী হিসেবে রংপুর মহানগর জাসদের সদস্য ও ‘তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও’ সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শফিয়ার রহমানকে দলীয়ভাবে মনোনীত করা হয়েছে। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিশ, বাসদসহ বিভিন্ন দলের মোট ১৫ জনেরও বেশি মেয়র পদের জন্য প্রচার চালাচ্ছেন। প্রচার চালাচ্ছেন ৩৩টি ওয়ার্ড এবং ১১টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের মহিলা কাউন্সিলরের জন্য প্রায় ২০০ প্রার্থী।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ২৭ ডিসেম্বর রংপুর সিটি করপোরেশনের ভোটগ্রহণ করা হবে। নির্বাচনে মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিন ২৯ নভেম্বর। ১ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র বাছাই এবং ৮ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ। প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে পরের দিন ৯ ডিসেম্বর। প্রার্থীরা ১৭ দিন প্রচারের সুযোগ পাবেন। ২৭ ডিসেম্বর ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলবে। সব ভোটকেন্দ্রে সিসি টিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে। রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসির যুগ্ম সচিব নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (ইটিআই) মহাপরিচালক আবদুল বাতেনকে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ২৮ জুন রংপুর পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করে সরকার। একই বছরের ২০ ডিসেম্বর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে ১ লাখ ৬ হাজার ২৫৫ ভোট পেয়ে প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু। ৭৭ হাজার ৮০৫ ভোট পেয়ে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বর্তমান মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। আর ২০১৭ সালের নির্বাচনে মেয়র সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুকে প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা।
৩৪ জনের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ : রংপুর আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসসূত্রে জানা যায়, গত ৭ নভেম্বর রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে মনোনয়নপত্র বিতরণ শুরু হয়। মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত মেয়র ও কাউন্সিলর পদে ৩৪ জন মনোনয়নপত্র কিনেছেন।
গতকাল দুপুরে বর্তমান সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার পক্ষে মনোনয়নপত্র কিনেছেন পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান এসএম ইয়াসির। এর আগে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রংপুর মহানগরের সাধারণ সম্পাদক আমিরুজ্জামান পিয়াল মেয়র পদে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন।
এ ছাড়া সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২১ এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলর (নারী) পদে ১১ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা আচরণবিধি মেনে কোনো রকমের শোডাউন ছাড়াই মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন বলে জানিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম সচিব আবদুল বাতেন। তিনি জানান, তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ২৯ নভেম্বর। ১ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র বাছাই এবং ৮ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ। প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে পরের দিন ৯ ডিসেম্বর। আগামী ২৭ ডিসেম্বর ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ভোটগ্রহণ চলবে।