স্বদেশ ডেস্ক:
নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার ৫ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে শত শত মন ইলিশ এসেছে বরিশালের মোকামে। এত কম সময়ে এই বিপুল ইলিশের আমদানিতে বিস্মিত সবাই। ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুক্রবার মধ্যরাতে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষে মাছ ধরতে নদী মোহনা আর সাগরে গেছে ট্রলার। সেগুলো ফিরতে আরও ২-৩ দিন লাগবে। এর আগে অভ্যন্তর ভাগের নদ-নদী থেকে কিছু ইলিশ ধরা পড়তে পারে। তবে তার পরিমাণ কখনোই শত শত মন হওয়ার কথা নয়। একাধিক আড়ত মালিক বলেন, ‘মাত্র ৫-৬ ঘণ্টার মধ্যে আসা এই মাছ কোনোভাবেই শনিবার ভোর রাতের নয়। এইটুকু সময়ে এত ইলিশ ধরা অসম্ভব। নিষেধাজ্ঞার সময় চুরি করে ধরা হয়েছে এসব ইলিশ। বরফ দিয়ে নয়তো ফ্রিজে সংরক্ষণের পর শনিবার তোলা হয়েছে মোকামে। শুধু বরিশাল মোকামেই যদি এত চোরাই ইলিশ আসে তো পুরো দক্ষিণাঞ্চলে কি হয়েছে সেটা ভেবে দেখুন।’ এদিকে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে বাজারে মিললেও মোটেই কমেনি ইলিশের দাম। নিষেধাজ্ঞার আগের দামেই শনিবার বিক্রি হয়েছে ইলিশ।
প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষায় ২ অক্টোবর থেকে নদ-নদী, সাগরে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। শুক্রবার রাত ১২টায় শেষ হয় এ নিষেধাজ্ঞা। এরপরই জাল নিয়ে নদ-নদী, সাগরে মাছ ধরতে নামেন জেলেরা।
বাংলাদেশ মৎস্য ট্রলার মালিক ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘প্রস্তুতি নেওয়া ছিল আগে থেকেই। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পরপরই বরগুনার পাথরঘাটাসহ দক্ষিণ উপকূলের প্রায় সব পয়েন্ট থেকে মাছ ধরতে সাগরে গেছে শত শত ট্রলার। দিনে দিনে মাছ ধরে ফিরে আসা ট্রলারগুলো শনিবার গভীর রাতের দিকে মাছ নিয়ে ফিরবে মোকামে। যেগুলো গভীর সমুদ্রে গেছে সেগুলোর ফিরতে কম করে হলেও ২-৩ দিন সময় লাগবে।’ পাথরঘাটা মোকামে শনিবার সকাল নাগাদ কি পরিমাণ ইলিশ এসেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যতদূর জানি ২৫-৩০ মনের বেশি নয়। স্থানীয় নদ-নদীতে যতটুকু ধরা পড়েছে তাই।’
প্রায় একই পরিমাণ ইলিশ মোকামে আসার খবর মিলেছে পটুয়াখালীর আলীপুর-মহিপুর মোকামে। সেখানকার ব্যবসায়ীরা জানান, ‘সবমিলিয়ে ৪০-৫০ মনের বেশি মাছ আসেনি। যা এসেছে তার সবটাই লোকাল। স্থানীয় নদ-নদী থেকে ধরা।’ সাগর পারের মৎস্য কেন্দ্রগুলোর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র বরিশালের ইলিশ মোকামে। শনিবার ভোর রাত থেকেই এখানে আসতে শুরু করে শত শত মন ইলিশ। ইঞ্জিনচালিত নৌকাসহ বিভিন্ন যানবাহনে এসব ইলিশ আসে আড়তে।
বরিশাল মোকামের ব্যবসায়ী গোপাল চন্দ্র বলেন, ‘শনিবার সকালে কম করে হলেও ৫-৬শ মন ইলিশ এসেছে। যার অধিকাংশই লাল। সাধারণত বরফ দিয়ে ৪-৫ দিনের বেশি রাখলে ইলিশের চেহারা এমন হয়। দেখেই বোঝা যায়, এগুলো নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন ধরা। রাতে অথবা চুরি করে গোপনে ধরা হয়েছে। অভিযানের ভয়ে বাজারে না এনে বরফ দিয়ে অথবা বড় ফ্রিজে সংরক্ষণের পর আনা হয়েছে মোকামে।’
আরেক ব্যবসায়ী কামাল হোসেন বলেন, ‘এটা তো ফি বছরের ঘটনা। নিষেধাজ্ঞার সময় চোরাইভাবে মাছ শিকার করে সংরক্ষণ এবং নিষেধাজ্ঞা শেষে মোকামে এনে বিক্রি করা। এর সঙ্গে কিছু অসাধু মৎস্য ব্যবসায়ীও জড়িত।’ বরিশাল মোকামের আব্দুল্লাহ ফিশ ট্রেডিংয়ের মালিক জহির সিকদার বলেন, ‘যেসব মাছ শনিবার এসেছে তার সিংহভাগই মা ইলিশ। প্রায় সব মাছের পেটেই ডিম। বহু বছর ধরে এই মোকামে ব্যবসা করছি। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, লোকাল জেলে কিংবা স্থানীয় নদ-নদীতে মাত্র ৫-৬ ঘণ্টায় এত ইলিশ ধরা অসম্ভব। ৫-৬ ঘণ্টার মধ্যে ৫-৬শ মন ইলিশ ধরার মতো জাল আর নৌকাই তো নেই। সরকার এত কষ্ট করে নিষেধাজ্ঞা দিল। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে অভিযান চালাল। অথচ অভিযান ফাঁকি দিয়ে ধরা হলো শত শত মন ইলিশ। তাহলে এ নিষেধাজ্ঞার ফল কী?’
৩ সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞা শেষে বাজারে আসতে শুরু করলেও মোটেই কমেনি ইলিশের দাম। নিষেধাজ্ঞার আগের দামেই শনিবার ইলিশ কেনা বেচা হয়েছে পাইকারি বাজারে। মোকাম ঘুরে দেখা গেছে এলসি সাইজের (৭শ গ্রাম থেকে ১ কেজির নিচে) ইলিশ প্রতি মন (৪২ কেজি) ৩৫ থেকে ৩৬ হাজার টাকায় কেনাবেচা হয়েছে আড়তগুলোতে। এর নিচে অর্থাৎ ৩শ থেকে ৭শ গ্রাম পর্যন্ত ইলিশের মন ছিল ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা। কেজি সাইজের ইলিশ ৪০ হাজার টাকা দরে জেলেদের থেকে কিনেছেন পাইকাররা। দেড় কেজির বেশি ওজনের ইলিশ পরিমাণে কম থাকায় তা কেনাবেচা হয়েছে প্রতি কেজি ১ হাজার ২৫০ টাকা দরে।
মোকামের একাধিক ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, ‘মাছের পরিস্থিতি খুব একটা ভালো না হওয়াই শনিবার আসা ইলিশের সিংহভাগ সরবরাহ করা হয়েছে লোকাল মার্কেটে। যেগুলোর অবস্থা মোটামুটি ভালো সেগুলো পাঠানো হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এমনিতেই এসব মাছ বহুদিন বরফ দিয়ে রাখা হয়েছে। বরিশালের বাইরে পাঠাতে গেলে আরও কয়েকদিন বরফ দিয়ে রাখার ঝুঁকি নিতে হবে। সেক্ষেত্রে নরম হওয়া কিংবা পচে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বেশিরভাগ ব্যবসায়ী তাই ঝুঁকি নেননি।’
পাইকারি বাজারের তুলনায় দেড় থেকে দ্বিগুণ দামে ইলিশ বিক্রি হতে দেখা গেছে লোকাল বাজারে। ৮৫৭/৬০ টাকা কেজি দরে পাইকারি বাজারে বিক্রি হওয়া ইলিশ লোকাল বাজারে প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১২ থেকে ১৪শ টাকা কেজি। এলসি সাইজে পাইকারি বাজার থেকে কেনা এই ইলিশ ওজন অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন দামেও বিক্রি করতে দেখা গেছে। বরিশাল ইলিশ মোকামের ব্যবসায়ী মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘শনিবার মোকামে যে মাছ এসেছে তার মান খুব একটা ভালো নয়। ইতোমধ্যে সাগরে মাছ ধরতে গেছে ট্রলার। ২-৩ দিন পর এগুলো আসতে শুরু করলে ইলিশের আমদানি যেমন বাড়বে তেমনি দামও কমতে পারে।’
নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার ৫-৬ ঘণ্টার মধ্যে শত শত মন ইলিশ ধরা পড়ার ব্যাপারে কথা বলার জন্য মৎস্য বিভাগের উপ-পরিচালক আনিসুর রহমান তালুকদারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি তা ধরেননি।’