শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ১২:১৩ অপরাহ্ন

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ফের ভেস্তে গেল

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ফের ভেস্তে গেল

স্বদেশ ডেস্ক:

বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয়রত রোহিঙ্গারা কেউ শর্তহীনভাবে মিয়ানমারে ফিরতে রাজি না হওয়ায় দ্বিতীয়বারের মতো কার্যত ভেস্তে গেছে বহুল প্রত্যাশিত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অপেক্ষার পরও কোনো রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যেতে ট্রানজিট ক্যাম্পে আসেনি। ফলে হতাশার মধ্যেই দিনটি পার করতে হয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। যদিও বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, নিজ দেশে ফিরে যেতে রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার ও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন তারা।

তবে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এখনো এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। এর আগে একই কারণে গত বছর ১৫ নভেম্বর সব প্রস্তুতি সম্পন্নের পরও রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানানোয় প্রত্যাবাসনের প্রথম উদ্যোগ ভেস্তে যায়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে এবার মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতেই রোহিঙ্গাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তবুও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, নিরাপত্তা, চলাফেরার স্বাধীনতা, হত্যা-নির্যাতনের বিচার ইস্যুতে নিশ্চিত ঘোষণা না আসায় এ সংকট সমাধানের দ্বিতীয় দফার চেষ্টাও দৃশ্যত ব্যর্থ হলো।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের গ্রামে গ্রামে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন ও জ্বালাও পোড়াও চালায় দেশটির সেনাবাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের উপকূলে এসে আশ্রয় নেয়। ফলে সৃষ্টি হয় এই শতাব্দীতে দক্ষিণ এশিয়া তথা বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকটের। এ নিয়ে নানামুখী আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার পর সম্প্রতি মিয়ানমার যাচাই-বাছাই করা ৩৫৪০ জন রোহিঙ্গাকে প্রথম দফায় ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়।

কক্সবাজারের স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে গতকাল বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। রোহিঙ্গাদের বহনে তৈরি ছিল ৫টি বাস ও ৩টি ট্রাক, তৈরি ছিল মেডিক্যাল টিমও। প্রত্যাবাসন সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা, মিয়ানমার ও মধ্যস্থতাকারী দেশ চীন দূতাবাসের প্রতিনিধিরাও ছিলেন উপস্থিত। এ উপলক্ষে টেকনাফের নয়াপাড়া থেকে দক্ষিণের শালবাগান এবং জাদিমুরা এলাকা থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম পর্যন্ত নেওয়া হয়েছিল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কিন্তু সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অপেক্ষার পরও কোনো রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যেতে ট্রানজিট ক্যাম্পে না আসায় প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি।

জানা গেছে, প্রথমদিন প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ভেস্তে গেলেও বাংলাদেশ এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আজও প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। পাশাপাশি যদি কেউ যেতে রাজি হয় তবে তাকে পাঠানোর প্রক্রিয়াও প্রস্তুত থাকবে। ১০৩৭টি পরিবারের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ২৯৫ পরিবারের একজন প্রতিনিধির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তাদের কেউ দেশে ফিরে যেতে রাজি হননি। পরে বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম, ঢাকাস্থ চীন দূতাবাসের দুজন প্রতিনিধি এবং মিয়ানমার দূতাবাসের একজন প্রতিনিধি এক যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন। পৃথক প্রেস ব্রিফিং করেছে রোহিঙ্গারাও।

ব্রিফিংয়ে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম বলেন, ‘আমাদের দিক থেকে আমরা সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকায় থাকা ১০৩৭টি পরিবারের মোট ৩৫৪০ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কেউ এখনো স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে রাজি হননি। এ পর্যন্ত ৩৩৯টি পরিবারের একজন করে প্রতিনিধির সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। আমরা এই প্রক্রিয়া চালিয়ে যাব। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বাস ও ট্রাকগুলো সেখানে উপস্থিত থাকবে। প্রত্যাবাসনে আগ্রহী কেউ এলেই পরিবহনগুলোতে করে তাদের সীমান্তে পৌঁছে দেওয়া হবে।’

চীন দূতাবাসের প্রতিনিধি ঝেং তিয়ানঝু বলেন, ‘প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনায় মধ্যস্থতার দায়িত্ব তার দেশ নিয়েছে। তবে সবচাইতে বড় প্রশ্ন, রোহিঙ্গারা কোনো নিজ দেশে ফিরতে চায় না? কেন তারা মিয়ানমারের ওপর আস্থা পাচ্ছে না। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত মিয়ানমারের কূটনীতিকদের কাছে বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা এ প্রশ্নগুলো বারবার করলেও তারা কোনো জবাব দেননি।

দুপুরে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে প্রেস ব্রিফিংয়ে শালবাগান ক্যাম্পের চেয়ারম্যান বদরুল ইসলাম তাদের ৫ দফা দাবি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারকে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, কেড়ে নেওয়া জমি ফেরত, ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, চলাফেরার স্বাধীনতা ও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তা হলেই কেবল রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে। এ সময় রোহিঙ্গা জাতিসংঘের মাধ্যমে রাখাইনে নিরাপত্তা দেওয়ারও দাবি জানায়। বদরুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমার আমাদের সঙ্গে সংলাপের কথা বলে প্রত্যাবাসন শুরু করে দিয়েছে, এটা ঠিক না। তাদেরকে আগে আমাদের সঙ্গে সংলাপ করতে হবে।

এ দিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়াকে দুঃখজনক উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত না যাওয়ার জন্য যারা প্ররোচনা দিয়েছে, যারা ইংরেজিতে পোস্টার, প্ল্যাকার্ড লিখে সাপ্লাই দিয়েছে এবং যেসব এনজিও না যাওয়ার জন্য তাদের আহ্বান জানিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, মিয়ানমারের উচিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে যে আস্থার সংকট আছে সেটা দূর করা। সমস্যাটি তাদের সৃষ্টি, সমাধানও তাদেরই করতে হবে। আমার পরামর্শ থাকবে তারা বাংলাদেশে অস্থায়ী আশ্রয়ে থাকা রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের (মাঝি) মিয়ানমারে নিয়ে যাক। মিয়ানমার রাখাইনে কী উন্নয়ন করেছে, রোহিঙ্গাদের জন্য কী বব্যস্থা করেছে, তাদের নিরাপত্তার জন্য কী আয়োজন রয়েছে সেটা তাদের দেখাক। বাংলাদেশ থেকে সাংবাদিকদেরও নিয়ে যেতে পারে। এতে আস্থার সংকট দূর হবে এবং রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনে উৎসাহিত হবে।

গতকাল বিকালে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। একইদিন কিছু এনজিওর তৎপরতা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও। এক বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে এই অভিযোগ শুনে সেই এনজিওগুলোকে চিহ্নিত করার সুপারিশ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। বৈঠকে আলোচনার পর কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয়েছে, কিছু কিছু এনজিও রোহিঙ্গাদের বোঝাচ্ছে, তারা যেন নিজ দেশে না যায়। কমিটি এসব এনজিওদের কাজ মনিটরিং করে তাদের চিহ্নিত করতে বলেছে। মিয়ানমারেও জাতিসংঘের অফিস আছে। তারাও সেখানে কাজ করুক। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ কোনো বার্গেনিং এজেন্ট না। মানবিক কারণে তাদের আমরা আশ্রয় দিয়েছি। তারা যাতে দেশে ফিরতে ভরসা পায়, সেজন্য তাদের প্রতিনিধি দলকে মিয়ানমার ঘুরিয়ে আনতে বলেছি। একইসঙ্গে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ‘সেফ জোন’ সৃষ্টির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য সংসদীয় কমিটির সদস্যদের সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম সফরের ব্যবস্থা করতেও সুপারিশ করা হয়েছে।

এ দিকে বারবার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ভেস্তে যাওয়ার পেছনে রোহিঙ্গাদের আস্থার সংকটকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক এম. হুমায়ুন কবির মনে করেন, রাখাইনের পরিবেশ নিয়ে মিয়ানমারের উদ্যোগে রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে পারছে না বলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু এটাও সত্য প্রত্যাবাসন শুরু করা না গেলে দিন যত যাবে পরিস্থিতি তত জটিল হবে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থার যে সংকট রয়েছে সেটি দূর না করে প্রত্যাবাসনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হলে সেটি ব্যর্থ হতে বাধ্য। কারণ ফিরে যেতে অনিচ্ছুক হলে আপনি জোর করে ফেরত পাঠাতে পারেন না। আন্তর্জাতিক আইন সেটি সমর্থন করে না। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা, অত্যাচার, ধর্ষণ হয়েছে। সুতরাং সেখানে ফিরে যেতে রোহিঙ্গারা নিরাপদ বোধ করবে না সেটিই স্বাভাবিক। এমনিতে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ আছে। চীন উদ্যোগ নিয়েছে। রাখাইনে যেন অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে সে জন্য মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিকভাবে আরও চাপ দিতে হবে। আর ক্ষেত্র প্রস্তুত না করে প্রত্যাবাসন শুরু করার উদ্যোগ নিলে বারবার ব্যর্থ হবে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877