বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:০৬ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
কাবুল কাশ্মির ও করাচি

কাবুল কাশ্মির ও করাচি

বন্দুকের শক্তি দিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠের জুলুম বহু জাতির পতনের কারণ হয়েছে। নিকট অতীতে এর সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো সুপারপাওয়ার টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া। অনেক শক্তিধর জাতি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি। শিক্ষা গ্রহণ না করাদের তালিকার শীর্ষে রয়েছে আমেরিকা, ইসরাইল ও ভারত। আমেরিকা আফগানিস্তানে সেই ভুলটাই করেছে, যা সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে করেছিল। সোভিয়েতের পতন বেশ কিছু স্বাধীনতা আন্দোলনকারীকে নতুন জীবন দান করে। তন্মধ্যে কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনও অন্যতম।

সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে বিক্ষোভ দমনের জন্য নির্মমভাবে ক্লাস্টার বোমা নিক্ষেপ করেছিল। তারপরও ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান থেকে পালাতে বাধ্য হয়। এটা সেই বছর, যখন অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মিরে ভারতীয় বাহিনীর ওপর বড় বড় হামলা হতে থাকে। এক সুপারপাওয়ারের গোলামি থেকে কাবুলের মুক্তি পাওয়ার পাশাপাশি কাশ্মিরে স্বাধীনতার নতুন আকাক্সক্ষা জন্ম নেয়। ওই আকাক্সক্ষাকে শেষ করে দেয়ার জন্য ভারত পাকিস্তানের ওপর চাপ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আর এ উপলক্ষে পাকিস্তানের অর্থনীতির মূল কেন্দ্র করাচিকে ভারত লক্ষ্যবস্তু বানাতে শুরু করে। কাবুল, কাশ্মির ও করাচির এ সম্পর্ক আজো বিদ্যমান।

কাবুল ও কাশ্মিরের সম্পর্ক বেশ পুরনো। ১৯৪৭ সালে কাবুলের এক আলেমে দ্বীন মোল্লা সাহেব শোরবাজার জম্মু-কাশ্মিরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে জুলুম-নির্যাতনের খবর পেলে তিনি তার ভক্তদের কাশ্মিরে জিহাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ নির্দেশ পাওয়ার পর আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বেশ কিছু গোত্র কাশ্মির অভিমুখী হয়। ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাজয়ের পর অনেক আফগান মুজাহিদও কাশ্মির উপত্যকার দিকে রওনা করেছিলেন। নব্বই দশকে অসংখ্য আফগান মুজাহিদ অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরের বিভিন্ন এলাকায় শহীদ হন। নাইন ইলেভেনের পর মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান পৌঁছলে এসব আফগান এক নতুন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। আমেরিকাও আফগানিস্তানে মুহুর্মুহু ক্লাস্টার বোমা নিক্ষেপ করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো আমেরিকাও আফগানদের গোলাম বানাতে সফল হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১০ বছর পর আফগানিস্তান থেকে পালিয়েছিল। আর আমেরিকা ১৮ বছর পর পালাচ্ছে। যে আমেরিকা জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে আফগান তালেবানকে ‘সন্ত্রাসী’ ঘোষণা করিয়ে নিয়েছিল, আজ সেই আমেরিকা ওই তালেবানের সাথে আলোচনা করছে।

১৯৮৯ সালে পাকিস্তান আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনীর প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ২০১৯ সালেও পাকিস্তান আফগান তালেবান ও আমেরিকাকে আলোচনার টেবিলে আনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার তা স্বীকার করছেন। যখন থেকে ট্রাম্প কাশ্মির সমস্যার সমাধানের জন্য পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাবকে বারবার উপস্থাপন করেছেন, তখন থেকে নয়াদিল্লির শাসক মারাত্মক ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তার আশঙ্কা, যদি আফগান তালেবান ও আমেরিকার মধ্যে কোনো শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়ে যায়, তাহলে কাশ্মিরের ওপর সেই প্রভাবটাই পড়বে, যা ১৯৮৯ সালে হয়েছিল। আফগান সঙ্কট সমাধান হয়ে যাওয়ার পর কাশ্মির সমস্যার সমাধানের জন্য ভারতে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে পারে।

আফগান সঙ্কটের সমাধান ভারতের জেদি ও একগুঁয়ে শাসকদের স্বার্থানুকূল নয়। আফগান তালেবান ও আমেরিকার মধ্যে যে গতিতে আলোচনা এগিয়ে চলেছে, সে গতিতে ভারতের পক্ষ থেকে অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরে শক্তির ব্যবহার বেড়ে চলেছে। ভারত হঠাৎ করে জম্মু-কাশ্মিরের বিভিন্ন স্থানে (৩৭০ ধারা বাতিলের আগে) সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। এতে ভারতীয় মিডিয়াও বেশ অবাক ও পেরেশান। ভারতীয় বাহিনী নিয়ন্ত্রণরেখায় আক্রমণও বৃদ্ধি করেছে। মজলুম কাশ্মিরিদের ওপর ক্লাস্টার বোমা বর্ষণ শুরু করে দিয়েছে। ফলে নারী-শিশুর প্রাণহানি ঘটছে। ভারতের পক্ষ থেকে অধিকৃত জম্মু-কাশ্মির ও আজাদ কাশ্মিরের জনবসতির বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক কৌশলের নবতরঙ্গ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, দুনিয়ার সবচেয়ে বড়, কথিত পারমাণবিক গণতন্ত্র কাশ্মিরে ওই ভুলেরই পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে, যে ভুল আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা করেছিল।

ক্লাস্টার বোমার ব্যবহার শক্তি নয়, দুর্বলতার প্রমাণ। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ভারতের জালিম শাসক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরে সেটাই করতে যাচ্ছে, যা ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের সাথে করা হয়েছিল। ভারতের সংবিধান মোতাবেক ভারতের অকাশ্মিরি নাগরিকরা জম্মু-কাশ্মিরে কোনো জমি ক্রয় করতে পারবে না। ভারতের শাসকদল তাদের সংবিধানে কাশ্মিরিদের প্রদত্ত এ গ্যারান্টি বিলুপ্ত করতে চাচ্ছে। আর অধিকৃত রাজ্যকে ভাগ করার পরিকল্পনা করছে। (এ আশঙ্কা এবার সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে -অনুবাদক) গণহত্যার মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হবে।

অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরে জুলুম নির্যাতন বেড়ে চলেছে, অপর দিকে বন্দী কাশ্মিরি নেতাদের ছলচাতুরী করে ভারত সরকারের সাথে আলোচনায় বাধ্য করা হচ্ছে। বর্তমানে ইয়াসিন মালিক, শাবির আহমদ শাহ, মুসাররাত আলম, আসিয়া আন্দ্রাবি ও আলতাফ শাহসহ ৪০ জন স্বাধীনতাকামী নেতাকে নয়াদিল্লির তিহার জেলে রাখা হয়েছে। ইয়াসিন মালিককে জেলে নিঃসঙ্গ কয়েদখানায় রাখা হয়েছে। তার শোয়ার জন্য কোনো বিছানাও নেই, চাদরও নেই। তিনি মাটিতে শোয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু ছাদে ঝোলানো হাইভোল্টেজের একটি বাল্ব তাকে শুতে দেয় না। ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কর্মকর্তা ভিত্তিহীন বিভিন্ন মামলার তদন্তের নামে তাকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে আলোচনার জন্য রাজি করার চেষ্টা চালিয়েছেন। ইয়াসিন মালিক যখন তা অস্বীকার করেছেন, তখন তার ওপর কঠোর নির্যাতন চালানো হয়েছে। তিনি হার্ট ও লিভার রোগে আক্রান্ত। সম্প্রতি নির্যাতনের কারণে তার চোখ ও একটি কানেও সমস্যা দেখা দিয়েছে।

ভারত সরকার যেকোনো মূল্যে ইয়াসিন মালিকের মনোবল ভেঙে দিতে চাচ্ছে। কেননা তিনি হুররিয়াত কনফারেন্সের দুটি ধারাকে এক করে ভারত সরকারের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছেন। সায়্যিদ আলি শাহ গিলানি ও মীর ওয়ায়েজ উমর ফারুকের জোট নয়াদিল্লির জন্য এক ভয়ঙ্কর স্বপ্ন। আর এ স্বপ্ন থেকে মুক্তির জন্য তারা ইয়াসিন মালিকের জীবনকে আজাবে পরিণত করেছে। এ কারণে প্রবীণ নেতা সায়্যিদ আলি গিলানি সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে বিশেষ বার্তায় বলেছেন, যদি আমরা সবাই শহীদ হয়ে যাই, আর আপনারা নীরব থাকেন, তাহলে আখেরাতে আল্লাহ তায়ালার কাছে কী জবাব দেবেন? গিলানি সাহেব বলেছেন, ভারত সরকার কাশ্মিরে মানবেতিহাসের সবচেয়ে বড় গণহত্যা শুরু করতে যাচ্ছে। গিলানি সাহেবের বার্তা আমাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কেননা এটা কাশ্মিরের প্রতিটি মজলুমের আওয়াজ। একটু ভাবুন, কাশ্মিরিদের অপরাধটা কী?

তাদের অপরাধ, স্বাধীনতাকে ভালোবাসা। তাদের অপরাধ ‘পাকিস্তানকে ভালোবাসা’। পাকিস্তানিরা কি তাদের স্বদেশকে এতটা ভালোবাসে, যতটা কাশ্মিরিরা পাকিস্তানকে ভালোবাসে? সময় এসেছে পাকিস্তানিদের কাশ্মিরিদের জন্য এমনভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়া, যেভাবে তারা পাকিস্তানের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। কাশ্মিরিদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা পাকিস্তানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। আজ পুরো বিশ্বকে আমাদের এ কথা জানানো প্রয়োজন, ভারতের পক্ষ থেকে কাশ্মিরিদের ওপর নতুন করে সেনা অভিযান ও নিয়ন্ত্রণ রেখায় ক্লাস্টার বোমা বর্ষণের পেছনে এ শঙ্কা রয়েছে, যদি আমেরিকা কাবুল থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে কাশ্মির বিশ্বের ফোকাসে পরিণত হবে। ভারত যা কিছুই করুক না কেন, কাশ্মিরিরা তাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবেই।

লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ০৫ আগস্ট, ২০১৯ সংখ্যা থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877