রবিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫, ০৪:১০ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে হোয়াইটওয়াশ এড়ালো শ্রীলঙ্কা রাজধানীতে ৩৪ চোরাই মোবাইলসহ চোরচক্রের সদস্য গ্রেপ্তার হোয়াটসঅ্যাপে স্লিপ গ্রহণ করবে হাইকোর্ট বেঞ্চ সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে সরকার, গ্রেপ্তারের নির্দেশ যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ দাবানলের মধ্যেই চলছে লুটপাট, কারফিউ জারি অন্তঃসত্ত্বা সাংবাদিককেও হুমকির অভিযোগ টিউলিপের বিরুদ্ধে সিরিয়ায় আসাদের ‘বিশ্বস্ত’ কর্মকর্তার প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড এবি পার্টির চেয়ারম্যান মঞ্জু ও সম্পাদক ফুয়াদ মাদুরোকে গ্রেপ্তারে আড়াই কোটি ডলার পুরস্কার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চগড়ে তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রির ঘরে, মৃদু শৈত্যপ্রবাহ
জ্ঞানবাপী মসজিদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার

জ্ঞানবাপী মসজিদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার

মাসুম মুরাদাবাদী:

জ্ঞানবাপী মসজিদের আঙ্গিনায় পূজার অনুমতি সম্বলিত আরজিকে শুনানিযোগ্য হিসেবে গ্রহণ করে বানারসের জেলা জজ মুসলিম পক্ষের প্রমাণাদি খারিজ করে দিয়েছেন। এ ফয়সালায় হিন্দুপক্ষ উৎসব পালন করছে, আর মুসলমানদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে নৈরাশ্য। মনে হচ্ছে, এসব কিছু একটি সাজানো চূড়ান্ত পরিকল্পনা মাফিক হচ্ছে এবং এর পেছনে সেই শক্তিগুলোরই হাত রয়েছে, যারা নব্বই দশকে রাম জন্মভূমি আন্দোলন শুরু করেছিল। বাহ্যিকভাবে ওই আন্দোলনকে একটি ধর্মীয় আন্দোলনের নাম দেয়া হয়েছিল; কিন্তু এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কারো কাছে গোপন ছিল না। পরবর্তী দিনগুলোতে এটা প্রমাণিতও হয়েছে যে, সঙ্ঘ পরিবার বিজেপিকে ক্ষমতায় আনার লক্ষ্যে অযোধ্যার আন্দোলন শুরু করেছিল।

এতে তারা শতভাগ সফল হয়েছে। কিন্তু এখন যখন বিজেপি সম্পূর্ণরূপে কেন্দ্রের ক্ষমতায় বসে আছে এবং দেশের অধিকাংশ প্রদেশেও তাদের সরকার রয়েছে, তখন কোন সে উদ্দেশ্য নিহিত আছে, যার কারণে মুসলিম শাসকদের নির্মিত মসজিদগুলোকে মন্দিরে রূপ দেয়ার ভয়ঙ্কর ও ষড়যন্ত্রমূলক অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে? বাহ্যত এর একটাই উদ্দেশ্য, হিন্দুদের মাঝে গৌরবের অনুভূতি সৃষ্টি করে তাদের এক বিজেতা জাতি হিসেবে বাঁচার অধিকার প্রদান করা। আর মুসলমানদের এ অনুভূতি প্রদান করা যে, তারা এ দেশের আসল নাগরিক নয়, বরং তারা সেই আক্রমণকারীদের উত্তরসূরি, যারা এ দেশে আক্রমণ করেছে এবং মন্দিরগুলোকে ভেঙে মসজিদ বানিয়েছে। এ কারণেই একের পর এক মুসলিম শাসনামলের মসজিদগুলোকে টার্গেট করা হচ্ছে এবং প্রতিটি মসজিদের নিচে মন্দিরের অবশিষ্টাংশ খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে।

অযোধ্যার বাবরি মসজিদের পর কাশি ও মথুরার মসজিদগুলোকেই শুধু টার্গেট করা হয়নি; বরং এ তালিকায় প্রতিদিন নিত্যনতুন মসজিদ যুক্ত হচ্ছে। উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, আদালতের কাঁধে চেপে এ ভয়ঙ্কর কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। আর আদালত জেনে না জেনে এতে মদদগার হচ্ছেন। নতুবা কী কারণ রয়েছে যে, কাশি ও মথুরার মসজিদগুলোর পর এখন বাদায়ুনের ঐতিহাসিক শামসী জামে মসজিদের বিরুদ্ধে সিভিল জজের আদালতে দায়েরকৃত মামলাও শুনানির জন্য মঞ্জুর হয়েছে। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে বাদায়ুনের এই ঐতিহাসিক জামে মসজিদকে শিবমন্দির অভিহিত করে গেরুয়া গোষ্ঠী এখানে পূজার অনুমতির আবেদন করে। এর সাথেই মথুরায় শাহী ঈদগাহের পর আরো একটি মসজিদের বিরুদ্ধেও মন্দিরের দাবি উত্থাপন করা হয়। এ ইস্যুতেও আদালত সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াক্ফ বোর্ডকে নোটিশ জারি করেছেন।

এভাবে ভবিষ্যতে বাবরি মসজিদ বিতর্কের মতো ধ্বংসাত্মক বিবাদগুলোকে প্রতিহত করার জন্য ১৯৯১ সালে ধর্মীয় স্থানের নিরাপত্তা সম্পর্কিত যে আইন পাস করা হয়েছিল, তা আপনাআপনি অকার্যকর হতে দেখা যাচ্ছে। অথচ সুপ্রিম কোর্ট এই আইনকে অসার অভিহিত করার আরজিতে এখন পর্যন্ত কোনো রায় দেননি। কিন্তু যে দ্রুততার সাথে মসজিদগুলো নিয়ে আদালতগুলোতে মন্দিরের দাবি দায়ের করা হচ্ছে, তাতে তো এটাই স্পষ্ট হচ্ছে যে, দেশে এ ধরনের কোনো আইনই বিদ্যমান নেই। খোদ বানারসের জেলা জজ জ্ঞানবাপী মসজিদের আঙ্গিনায় পূজার অনুমতির আবেদনসংক্রান্ত আরজিকে শুনানির জন্য মঞ্জুর করে এ কথাই বলেছেন যে, ওই আইন এর জন্য প্রতিবন্ধক নয়। এ কারণেই এ ইস্যুতে দায়েরকৃত অপর মামলার প্রাত্যহিক শুনানি ৬ অক্টোবর থেকে শুরু হবে, যে মামলায় জ্ঞানবাপী মসজিদের চত্বরে মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা এবং জ্ঞানবাপী মসজিদের পুরো চত্বর হিন্দুদের হাতে সোপর্দ করার দাবি করা হয়েছে।

ওই মামলায় শিবলিঙ্গের পূজার অনুমতিও চাওয়া হয়েছে। আদালত আগেই বলে দিয়েছেন যে, যদি মুসলিম পক্ষ ৬ অক্টোবরের ভেতর তাদের জবাব দাখিল করতে না পারে, তাহলে তাদের সুযোগ শেষ করে দিয়ে আদালতের কার্যক্রম এগিয়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে মুনতাজির কায়েমীর এই কবিতা মনে পড়ল- ‘আদাল সে মুঁহ মোড় কার জাব মুনসিফী হোনে লাগে/সাখত কাফের জুরম ভী আব মাযহাবী হোনে লাগে’- ন্যায়বিচার থেকে মুখ ফেরানো ব্যক্তি যখন ন্যায়বিচারক সাজতে শুরু করেছে/ মারাত্মক পাপী কাফেরও তখন ধার্মিক সাজতে শুরু করে।

পাঠকের মনে থাকার কথা, সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদের ভূমি হিন্দুপক্ষকে অর্পণের রায় শোনানোর কালে স্পষ্টরূপে বলেছিলেন, এ বিষয়ের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে, বাবরি মসজিদ মন্দির ভেঙে নির্মাণ করা হয়েছিল। অনুরূপভাবে এ কথারও কোনো প্রমাণ নেই যে, বানারসের জ্ঞানবাপী মসজিদ কোনো মন্দির ভেঙে বানানো হয়েছে।

উল্লেখ্য, ১৯৩৭ সালের ভারত সরকারের বিরুদ্ধে দীন মুহাম্মদের মামলাতেও জ্ঞানবাপীকে মসজিদ স্বীকৃতি দিয়ে সেখানে মুসলমানদের নামাজের অধিকার দেয়া হয়েছে। কয়েক শতাব্দী ধরে জ্ঞানবাপী মসজিদে ক্রমাগত নামাজ আদায় হয়ে আসছে। এ জন্য এখানে ধর্মীয় স্থাপনার নিরাপত্তার আইন প্রযোজ্য। ১৯৪৪ সালে জ্ঞানবাপী মসজিদকে ওয়াক্ফ বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত করে প্রাদেশিক সরকার গেজেট প্রকাশ করেছিল। কাশি বিশ্বনাথ মন্দিরের চত্বরস্থ জমির বিনিময়ে জ্ঞানবাপীকে মসজিদ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। জ্ঞানবাপী মসজিদের মালিকানা ছিল মোগল শাসক আওরঙ্গজেবের নামে। আর তারই পক্ষ থেকে দেয়া জমিতে ১৬৬৯ সালে এ মসজিদ নির্মিত হয়েছিল।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে মন্দির ভাঙার অভিযোগ উত্থাপন করে থাকে। অথচ তার সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবিদ লিখেছেন, তিনি মন্দিরগুলোকে সম্পত্তি বরাদ্দ দেন এবং তাদের নজরানার ব্যবস্থা করেন। বিএন পান্ডেসহ বহু নিরপেক্ষ ইতিহাসবিদ তাদের গ্রন্থে এর প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু বর্তমানে দেশে যে স্রোতধারা বয়ে যাচ্ছে, তাতে কোনো যৌক্তিক কথা বলা বা সত্য প্রকাশ করা ঝুঁকিমুক্ত নয়। এ কারণেই বানারসের জেলা জজের সাম্প্রতিক ফয়সালায় মুসলিম সংগঠনগুলো ও নেতৃবৃন্দ তো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতা এটা বলেননি যে, মসজিদগুলোকে এভাবে বিতর্কিত বানানো এবং তাদের ঐতিহাসিক মর্যাদা বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেয়া এ আন্দোলন দেশকে গৃহযুদ্ধে ঠেলে দেবে।

সবাই জানেন, নব্বই দশকে যে সময় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মারাত্মক ভয়ঙ্কর ও বিদ্বেষপূর্ণ স্লোগান দিয়ে ‘রাম জন্মভূমি মুক্তি আন্দোলন’ শুরু করেছিল, ওই সময় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছেছিল। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ সালে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের শাহাদত ওই উত্তেজনা ও বিদ্বেষের ফল ছিল। যার কোনো অপরাধীকেই আজ পর্যন্ত কোনো শাস্তি প্রদান করা হয়নি। পক্ষান্তরে এর ফলে দেশের ভেতর অসংখ্য রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়েছে এবং হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ মৃত্যুর দুয়ারে চলে গেছে। কোটি কোটি রুপির সম্পদ ক্ষতি হয়েছে।

ভবিষ্যতে এই ক্ষতি ও বিদ্বেষ থেকে বাঁচার জন্য ১৯৯১ সালে ধর্মীয় স্থান ও স্থাপনার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। যেখানে চূড়ান্তরূপে এ নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল যে, এখন এ ধরনের কোনো বিতর্ক দেশে আর কোথাও কখনোই সৃষ্টি হবে না। কিন্তু বাবরি মসজিদের জমি সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে রামমন্দির নির্মাণের জন্য অর্পণ করার পর মসজিদগুলোর নিচে মন্দির অনুসন্ধানের অভিযান শক্তভাবে ভয়ঙ্কর সীমায় পৌঁছেছে এবং উগ্রপন্থীরা প্রতিদিন কোনো না কোনো ঐতিহাসিক মসজিদের নিচে মন্দির হওয়ার কথা বলে বিষনিঃশ্বাস ছড়াচ্ছে। সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, এ কাজ আদালতকে ব্যবহার করে সম্পাদন করা হচ্ছে, যা দেশের বিচারব্যবস্থার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২-এর উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877