শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ০২:২৪ পূর্বাহ্ন

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক অধ্যায়ের সমাপ্তি

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক অধ্যায়ের সমাপ্তি

বিশাল কর্মজীবন পেছনে ফেলে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে বেশ কিছুদিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই ভোর ৭টা ৪০ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন স্বাধীনতা-উত্তর সেনাবাহিনীর তৃতীয় সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (এরশাদ)। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বড় অধ্যায় শেষ হলেও থেকে যাবে রাজনৈতিক ইতিহাসে। তিনি বাংলাদেশের সেনাপ্রধান, যিনি একটি নির্বাচিত সরকার থেকে ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতাসীন থাকেন নয় বছরের ওপর। তৈরি করেছিলেন একটি রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় পার্টি’, যা আজও বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় ফ্যাক্টর। তবে এরশাদবিহীন ‘জাতীয় পার্টি’ কেমন থাকবে, তা দেখার বিষয়। এ ধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলের ইতিহাস সুখকর হয় না। এরশাদ স্বৈরাচারী হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে মৃত্যু পর্যন্ত অপরিহার্য ছিলেন।

জেনারেল এরশাদের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭৩ সাল থেকে, যখন তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্নেল হিসেবে অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল পদে নিয়োজিত ছিলেন। আমি তখন ঢাকায় ব্রিগেডের স্টাফ অফিসার। দাপ্তরিক কাজে বহুবার তার সঙ্গে মিটিং করতে হয়েছে। তখন থেকেই তাকে বেশ অমায়িক দেখেছি। আরও পরে তিনি উপপ্রধান হলেন, পরে সেনাপ্রধান। ওই সময় আমি সেনাসদরে যথেষ্ট সান্নিধ্য লাভ করেছি। তিনি অধস্তন অফিসারদের বেশ স্নেহ করতেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যার পর অত্যন্ত পরিপক্ব সামরিক সিদ্ধান্তের কারণে রক্তপাত এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। ওই সময় উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুর সাত্তারকে সমর্থন ও তৎকালীন সরকারকে সমর্থন করেছিলেন অনেক চাপ, প্রলোভন ও উস্কানির মধ্যেও। ওই সময় তার চারপাশের অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ ও মাঝারি র‌্যাংকের কর্মকর্তা ক্ষমতা দখলের প্ররোচনা দিলেও তিনি আমাদের অনেকের বিরোধী অবস্থানের সঙ্গে থেকেছিলেন। পরে আমি বিদেশে ট্রেনিংয়ে থাকার সময় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদের ক্ষমতা দখল করার কথা শুনলাম। (আমার রচিত প্রথম পুস্তক বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায়, ১৯৭৫-৮১ দ্রষ্টব্য)। তৃতীয় বিশ্বে যেন অভ্যুত্থান তখনো অহরহ বিষয় ছিল, তবে বহু দেশে রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা এবং কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের অথবা গোষ্ঠীর প্ররোচনার প্রেক্ষাপটেই রচিত হয় সামরিক অভ্যুত্থান।

ধারণা করলাম, তিনি ভেতর-বাইরের প্ররোচনায় একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এর পর বহুবার সাক্ষাৎকারে তিনি আমাকে প্রেক্ষাপট বলেছিলেন। তার সঙ্গে প্রায় ছয় বছর আগে এক সামাজিক অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম, তিনি ইতিহাসে একমাত্র সামরিক শাসক, যিনি ক্ষমতাচ্যুতির পরও রাজনৈতিক অঙ্গনে আমৃত্যু ফ্যাক্টর হয়ে থাকবেন। সামরিক অভ্যুত্থানের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।

জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বহুবিধ কারণে নন্দিত ও নিন্দিত হয়েছেন, হয়তো হয়েও থাকবেন। তবে তার অনেক দূরদর্শী পদক্ষেপ বাংলাদেশকে উন্নতির পথে নিয়েছে। উপজেলা পদ্ধতি ছিল এ বিশাল জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় প্রশাসনকে নিয়ে যাওয়া এবং নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত হওয়া। একদার থানা এখন ছোট ছোট শহরে পরিণত হয়েছে। এসব উপজেলাকে যোগাযোগের মধ্যে নিয়ে আসা এবং যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির শুরু ওই সময়েই। অর্থনীতিকে উন্মুক্তকরণ, পোশাকশিল্পকে সমর্থন এবং ব্যক্তিগত খাতে শিল্পায়নে উৎসাহ প্রদান ইত্যাদি ছাড়াও বড় অর্জন ছিল উপমহাদেশে তো বটেই, এশিয়ার অন্যতম যুগান্তকারী কাজ ‘জাতীয় ঔষধনীতি’ যার কারণে বাংলাদেশে ওষুধ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ থেকে সস্তা। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ উপমহাদেশে একটি সমতা বজায় রেখেছিলেন। ভারতের সঙ্গে অতিমাত্রায় না হলেও যেমন ভালো সম্পর্ক রেখেছিলেন, তেমনি পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকার সঙ্গে ছিল ভালো সম্পর্ক। ক্ষমতাচ্যুতির পরও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তার বিদেশনীতিও বেশ সফল হয়েছিল বলে প্রতীয়মান।

এ পর্যন্ত তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রপতি, যাকে আনুষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রে আমন্ত্রণ ও হোয়াইট হাউসে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তার সময়ে বাংলাদেশ সেনাদল প্রথম বিদেশে নিয়োজিত হয়েছিল ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের পর। এর পরই উন্মুক্ত হয় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন।

এত অর্জনের পরও এরশাদ সাহেব তার খোলামেলা ব্যক্তিগত জীবনের জন্য যেমন নিন্দিত, তেমনি রাজনীতিকে কলুষিত করার অভিযোগের জন্যও নিন্দিত। তার সময়েই নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা একেবারে নস্যাৎ হয়েছিল। অবশ্য এখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হওয়ার পর, নির্বাচনগুলোও তথাকথিত ‘স্বৈরতান্ত্রিক সিনড্রোমে’। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ ছিল। বলা হয়ে থাকে তিনি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ায় এরশাদবিহীন গত ৩০ বছরে দুর্নীতি এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। বর্তমানে দুর্নীতি কমার কোনো লক্ষণ নেই। এরশাদ-জাদু থেকে কেন বের হতে পারা যাচ্ছে না, সে ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় না। এখন যা শতগুণ বেড়েছে। বলা হয় বর্তমানে দুর্নীতির অভাবনীয় প্রসারও ‘এরশাদ সিনড্রোম’। তবে এরশাদ সাহেবের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ যে, তিনি দেশে ১৯৭৫-উত্তর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার উৎখাত করে বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে যে ‘সিনড্রোম’ ঢুকিয়েছেন তার জের এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকে ভঙ্গুর করে রেখেছে। তবে তিনি অনেকের কাছে রাজনীতির ‘দুষ্ট বালক’ (ব্যক্তি) হিসেবে পরিচিত থাকলেও আবার অনেকের কাছে তার বেশ কিছু সুদূরপ্রসারী কাজের জন্য নন্দিত থাকবেন।

এক কথায় বলা যায়, এরশাদ সাহেব ইতিহাসে নন্দিত আর নিন্দিত হয়েই জীবিত থাকবেন। তিনি এখন সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে। তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

য় ড. এম সাখাওয়াত হোসেন : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার এবং কলাম লেখক

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877