বাংলাদেশে সবচেয়ে উপেক্ষিত ও বঞ্চিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ মানুষটির নাম কৃষক। আপনি হয়তো ঢাকার পাঁচতারা হোটেলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ডাইনিং হলে বসে ভোজন করছেন। আপনার সামনে ভাত-রুটি, মাছ-গোশতের সালুন, সবজি এবং ফলের যে পাত্র দেয়া আছে এবং সেখানে যদি কোনো ফুলও থেকে থাকে, এসবের উৎপাদনকারী এমন এক ব্যক্তি যিনি দেশের সর্বাধিক জীর্ণ-শীর্ণ একটি নোংরা ঘরের বাসিন্দা- রুগ্ণদেহী কৃষক।
তিনি হয়তো দু’বেলা পেট ভরে খেতেও পান না। আপনি হয়তোবা দেশের নীতিনির্ধারক বা পরামর্শক। সে কৃষক আপনার দৃষ্টির অনেক আড়ালে এবং আপনিও তার নাগালের অনেক বাইরে। আপনি যদি সরকারদলীয় পদস্থ রাজনৈতিক নেতা হয়ে থাকেন তবে তার ভোটেরও আপনার প্রয়োজন হয় না। আপনি হয়তো মাঝে মধ্যে এই পাঁচতারা হোটেলে কৃষকের সুযোগ-সুবিধা এবং তার কর্মকাণ্ড নিয়ে মাঠপর্যায়ের কৃষিকর্মীদের সংগ্রহ করা ঠিক, বেঠিক উপাত্তের ভিত্তিতে প্রণীত, কোনো প্রখ্যাত কৃষি গবেষকের বিশ্লেষণের ওপর সেমিনার করেন। এর ভিত্তিতে কৃষিসংক্রান্ত পলিসি নির্ধারণ করেন; কিন্তু এতে স্বাধীনতার পর ৪৮ বছরেও কৃষকের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হলো না। কিন্তু আপনার নিজের ভাগ্যের শনৈঃশনৈ উন্নতি হচ্ছে; আর হচ্ছে তাদের যারা কৃষিপণ্য নিয়ে ব্যবসা করে এবং শহরে বন্দরে কৃষিপণ্য ভোগ করে থাকেন।
শহরবাসী অনেকেই হয়তো জানেন না, কী কঠোর পরিশ্রম করে কৃষক কৃষিপণ্য ফলান বরং একটি বহুল প্রচলিত চুটকি আছে- আজীবন শহরবাসী কেউ জিজ্ঞেস করেছিল ‘ধানগাছে তক্তা হয় কি না’। ব্রিটিশ লেখক সমারসেট মম (১৮৭৪-১৯৬৫) ১৯৩৮ সালে ভারতবর্ষ ভ্রমণে এসেছিলেন। ভ্রমন শেষে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘এই বিচিত্র ভারতবর্ষে দেখার মতো অনেক কিছুই আছে। তাজমহল দেখেছি। এর সৌন্দর্য আমাকে তেমন বিস্মিত করতে পারেনি। আমাকে বিস্মিত করেছে এই বিশাল ভারতের কোটি কোটি কৃষক যারা উদোম গায়ে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ক্ষেতে ফসল ফলায়।
আমি দেখেছি কী প্রখর রোদে পুড়ে কৃষক ক্ষেত নিড়াচ্ছে। রোদে পোড়া রুগ্ণ কৃষকদের দগ্ধ কালো পিঠের চামড়ায় ঘাম শুকিয়ে সাদা লবণ হয়ে প্রখর সূর্যের আলোয় চিক্চিক্ করছে। এ দৃশ্য অবর্ণনীয়। এর আগে এমন দৃশ্য কল্পনাও করতে পারিনি’ (লেখকের স্মৃতি থেকে, মূল : বিজ্ঞাপনপর্ব, কলকাতা, ১৯৮০-এর দশক)। এখন অবশ্য অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। কৃষকেরা কোনো কোনো অঞ্চলে গেঞ্জি বা শার্ট পরে ক্ষেতে যান। ছোটবেলায় গ্রামে গেলে দেখেছি, বর্ষায় বা বানের পানিতে পাটক্ষেত তলিয়ে গেলে কী নিদারুণ কষ্ট স্বীকার করে কৃষকেরা গলাপানিতে ডুবে ডুবে পাটগাছ কাটতেন। দীর্ঘক্ষণ পানিতে অবস্থানের কারণে তার পা সাদা হয়ে আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে ঘা হয়ে যেত। নিরাময়ের জন্য পানিতে খয়ের গুলিয়ে ঘায়ে মাখতে হতো। এখন তো পাট জাগ দেয়ার মতো পানিও নেই। ফারাক্কা বাঁধ অগস্ত্য মুনির মতো বাংলাদেশের সব পানি শুষে নিয়েছে।
কৃষিপ্রধান এই দেশে কৃষকের অবদান সর্বত্রই। কৃষক তার সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার স্ফীত করছেন। কৃষক নিজের সন্তানকে দেশের তৈরী পোশাক শিল্পে কাজে পাঠিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার স্ফীত করছেন। কৃষাণ-কৃষাণী আপনার গৃহভৃত্য। নদীভাঙনের শিকার উদ্বাস্তু ও অন্যান্য অসহায় কৃষক এসে শহরের যাবতীয় শ্রীবৃদ্ধির কাজ করছে। আরো কত কী। কৃষকের এ ধরনের কর্মের অবদান সংক্ষেপে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইলামের ভায়ায়- ‘রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,/রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,/বল তো এসব কাহাদের দান? তোমার অট্টালিকা/কার খুনে রাঙা? ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইটে আছে লিখা’। তারা সবাই গ্রামে কর্মহীন লাচার কৃষক। এসব নির্মাণে সরকারের আগ্রহের ঘাটতি নেই। আগ্রহের ঘাটতি দেখা যায় কেবল কৃষকের উদ্বৃত্ত ফসল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার দিকে। বর্তমান কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলছেন, কৃষকের ধান কিনতে সরকারের টাকার অভাব নেই। অভাব হলো ধান সংরক্ষণের গুদামের।
টাকা ছাপাবার সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসটি সরকারের হাতে, সুতরাং যেকোনো কাজে টাকার অভাব না হওয়ারই কথা। কৃষক গ্রামে কাজ হারিয়ে, বাস্তুভিটা হারিয়ে শহরে এসে শহরবাসীর জন্য ফ্লাইওভার, অ্যালিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল ও অন্যান্য নির্মাণকাজ করছেন মজুর হয়ে। এসব নির্মাণে শ্রম দিতে হলেও গ্রামের কৃষক কতটা ভোগ করবেন? দেশের ৮০ শতাংশ লোক যারা কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট তাদের অনাবশ্যক এসব নির্মাণকাজ শহরে করা যায়, কৃষকের অতি আবশ্যকীয় পণ্যের গুদাম এত দিনেও নির্মাণ করা গেল না কেন? এ গুদাম নির্মাণ করা গেলে কৃষক হয়তো তার উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য পেতেন। কৃষিমন্ত্রী বলছেন, ধানের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে সরকারের ‘তেমন কিছু’ করার নেই।
আর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বললেন, ‘ধানের দাম পাওয়ার ব্যাপারে কৃষককে এবার লোকসানেই থাকতে হবে।’ এতে এ বিষয় স্পষ্ট যে, অসহায় অসংখ্য কৃষকের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আর চোখের পানি এ সরকারের হৃদয় গলাতে পারেনি এবং হয়তো পারবেও না। কারণ তাদের ক্ষমতায় আসতে দেশের ৮০ শতাংশ কৃষকসহ কারো ভোটের প্রয়োজন পড়েনি। ক্ষমতার লোকেরা লুটপাট করে খাবে আর রক্ত পানি করে কৃষিপণ্য উৎপাদন করে শহরবাসীকে যারা খাওয়াচ্ছেন সেসব কৃষক দেবেন লোকসান! একটি স্বাধীন দেশের মন্ত্রীর মুখে এসব কথা পুরো বেমানান। এমন কথা তারা বলতে পারেন এ কারণে যে, বিদেশ থেকে তারা যে সাহায্য বা ঋণ আনেন তা কৃষক ও অন্যান্য সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় পরিশোধ করা হলেও তাদের প্রতি দায় নেই কারচুপিপূর্ণ নির্বাচনে যারা ‘নির্বাচিত’, তাদের। সরকারের কি তাহলে জনগণের করের টাকা কৃষককে ভর্তুকি দিয়েই খালাস? ভর্তুকির টাকা কাজে লাগল নাকি পানিতে গেল সেটি কি সরকার দেখতে হবে না? সেই প্রবাদ ‘সরকার কা মাল দরিয়ামে ঢাল’ আজো সত্য। এ দিকে হচ্ছে কৃষকের মহা সর্বনাশ।
কৃষকেরা উৎপাদিত পণ্যের মূল্য পাচ্ছেন না, তবু সরকার বিদেশ থেকে কৃষিপণ্য আমদানি করে। ফরাসি সরকারের এ-জাতীয় কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে ২০১৮ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি সে দেশের কৃষকেরা ট্রাক্টর দিয়ে প্যারিসের রাজপথ অচল করে দিয়েছিলেন। আমাদের দেশের কৃষকেরা তার কষ্টে উৎপাদিত শস্যের মূল্য না পেয়ে তা রাজপথে ছিটিয়ে এবং নিজ শস্যক্ষেত্রে আগুন দিয়েছেন। রাজপথে ট্রাক্টর কিংবা লাঙ্গল-জোয়াল জড়ো করে সাহেব-সুবোদের চলার রাজপথ অচল করে দেয়ার সুযোগ তাদের নেই। দেশের সাধারণ লোক আজ খুবই অসহায়। রাজনীতিকদের একটি অতি উচ্চারিত আপ্তবাক্য – ‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে’। একটি কৃষিপ্রধান দেশে এটি অতি সত্য কথা। কিন্তু সরকার এ কথার বরখেলাপ হামেশাই করে যাচ্ছে।
ধান-চাল, আলু-টমেটো-পেঁয়াজজাতীয় ফসলের বাম্পার ফলন হলেও দেখা যায় সেসব পণ্য পাশের দেশ বা অন্য কোথাও থেকে আমদানি করে কৃষকের ভাগ্যকে ভেঙে চুরমার করে দেয়া হয়। সেসব পণ্য ক্ষেতে পচে যায় বা দেদার লোকসান দিয়ে কৃষক তা বিক্রি করতে বাধ্য হন। এটা হয় ক্ষমতাসীন দলীয় ব্যবসায়ীদের কারণে। পাট একসময় বাংলাদেশের কৃষকের প্রাণতুল্য ছিল। সাবেক পাকিস্তান আমলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী জুটমিলসহ এ অঞ্চলে প্রায় ৭৬টি পাটকল ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেল। বাংলাদেশের ‘সোনালি আঁশ’ হয়ে গেল কৃষকের ‘গলার ফাঁস’। বাংলাদেশের পাট নিয়ে পশ্চিম বাংলা পাটশিল্পের প্রসার ঘটাল। অপর দিকে, পাটের দাম না পেয়ে বাংলাদেশের কৃষক প্রথমে তা পোড়ালেন আর এখন এ পণ্য ধর্তব্যের মধ্যেই প্রায় নেই বলা যায়। এখন কৃষক ক্ষেতের ধান ক্ষেতেই পোড়াচ্ছেন যদিও ছোটবেলা দেখতাম ধান উঠে গেলে সে ক্ষেত উর্বর করার জন্য কৃষকেরা নাড়া পোড়াতেন।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশকে হতে হবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যুক্তরাজ্য খাদ্যশস্যের প্রায় ৪৮ শতাংশ এবং জাপান প্রায় ৬০ শতাংশ প্রতি বছর আমদানি করে। এসব উদাহরণ টেনে আনলে চলবে না, কারণ সেসব দেশকে খাদ্যঘাটতির দেশ বলা যাবে না। সেসব দেশ শিল্পোন্নত বলে খাদ্য আমদানি করার মতো রফতানিযোগ্য প্রচুর শিল্পপণ্য তাদের আছে। আমাদের তা নেই। আমদানির ওপর আমাদের নির্ভর করতে হলে কৃষক তো মার খাবেনই; অধিকন্তু এখন যেমন হচ্ছে তেমনি ভোক্তাকে অধিক মূল্যে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হবে, যা সাধারণ জনগণের নাগালের বাইরে। খাদ্যশস্য আমদানির টাকাইবা কিভাবে আসবে? তাই শতকরা ১০০ ভাগ খাদ্যশস্য নিজেদেরই উৎপাদন করতে হবে। এ ছাড়াও আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির কৃষি খাতের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শতকরা ৮০ ভাগ লোক জড়িত এবং তারা গ্রামে থাকেন। তাদের কর্মসংস্থান কৃষি এবং কৃষিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নানা ধরনের শিল্পের সাথে জড়িত। তাই কৃষকের গুরুত্ব আমাদের দেশে কিছুতেই গৌন করা যায় না। আমাদের বেশ জোর দিয়েই বলতে হবে- ‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে’। তাই আমাদের দেশে কৃষকের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা শুধু অন্যায় নয়- এ একধরনের পাপ।
কৃষকের প্রতি আমাদের দেশে এত অবহেলা কেন? এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের দেশের পার্লামেন্টে যারা প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং ক্ষমতায় যারা আছেন তাদের পেশাগত অবস্থানের দিকে তাকাতে হবে। তাদের প্রায় ৬১ শতাংশের বেশি কোটিপতি ব্যবসায়ী। কৃষিপণ্য নিয়েও তাদের রমরমা ব্যবসা। তাদের কেউ নজরুলের ভাষায় ‘সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটির মমতা-রসে’ নন। অনেকে দেশের সম্পদ দেদার লুটপাট করে বিদেশে ‘ফার্স্ট হোম’, ‘সেকেন্ড হোম’ গড়ছেন এবং দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছেন। দেশের পার্লামেন্টে সাধারণ লোক কিংবা সাধারণ লোকের নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। জনগণের কাছে তাদের কোনো দায়বদ্ধতাও দেখা যায় না। দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করে বিদেশী গাড়ি আমদানি ও চলাচলের সুবিধা হাসিল করে তারা মেগা লুটপাটে ব্যস্ত। অথচ এসব প্রজেক্ট রক্ষণাবেক্ষণের তেমন আয়োজন নেই। মানব উন্নয়নের পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টা থাকলে দেশের কৃষক তথা সাধারণ জনগণ ঠিকই উপকার পেতেন। আজ কৃষকের শিক্ষা নেই, স্বাস্থ্য নেই, উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নেই। লোকসান দিতে দিতে এবং অনাহারে অর্ধাহারে থেকে থেকে বাংলাদেশের কৃষক আজ মৃতপ্রায় ও বিপন্ন।
লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার