পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন বহুল আলোচিত দেশের শীর্ষস্থানীয় ইয়াবা ডন হাজি সাইফুল করিম (৪৫)। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে টেকনাফ স্থলবন্দরের সীমানাপ্রাচীরের শেষ প্রান্তে নাফ নদের পারে এ ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশের তিন সদস্য আহত হন।
ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র ও ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এক সপ্তাহ আগে গত শনিবার রাতে সাইফুল করিম মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন থেকে বিমানযোগে দেশে ফেরেন। পরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে পুলিশ কক্সবাজার নিয়ে যায়।
কক্সবাজারে পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় সাইফুল করিম জিজ্ঞাসাবাদে তার ইয়াবাকারবারে যুক্ত হওয়ার পেছনের গল্প, কারা তাকে সব সময় আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন, কারা নিয়মিত সুবিধা নিতেন সেসব রাঘববোয়ালের নাম জানিয়েছেন বলে সূত্র জানায়। সাইফুল করিম নিহত হওয়ায় নেপথ্যের এসব কুশীলবের কী হবে, ইয়াবা ব্যবসা কি বন্ধ হবে, এসব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন অনেকেই।
নিহত সাইফুল করিম টেকনাফ উপজেলার সদর ইউনিয়নের শিলবুনিয়াপাড়া এলাকার মো. হানিফ ওরফে হানিফ ডাক্তারের ছেলে।
সাইফুল করিম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষস্থানীয় ইয়াবাকারবারি। পুলিশ বলছে, তালিকায় তার নাম এক নম্বরে। এর পরই রয়েছে সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির নাম।
টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ জানিয়েছেন, ‘দেশের শীর্ষ ইয়াবা ডন সাইফুল করিমকে পুলিশ অস্ত্র ও মাদক মামলায় গ্রেপ্তার করেন। পরে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি পুলিশের কাছে স্বীকার করেন, কয়েক দিন আগে ইয়াবার একটি বড় চালান ইঞ্জিনচালিত বোটযোগে মিয়ানমার থেকে এনে টেকনাফের সদর স্থলবন্দরের সীমানাপ্রাচীরের শেষ প্রান্তে নাফ নদের পারে মজুদ রাখা হয়েছে।
ওই তথ্যের ভিত্তিতে ইয়াবা উদ্ধারে শুক্রবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে পুলিশের একটি দল তাকে নিয়ে ওই স্থানে পৌঁছলে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে আগে থেকে ওত পেতে থাকা তার অস্ত্রধারী সহযোগীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। এতে ঘটনাস্থলে এসআই রাসেল আহমেদ (৩৫), কনস্টেবল ইমাম হোসেন (৩০) ও কনস্টেবল মো. সোলেমান (৩৬) আহত হন। এ সময় পুলিশ আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছোড়ে। এতে আটক মো. সাইফুল করিম (৪৫) গুলিবিদ্ধ হন।
গোলাগুলির শব্দ শুনে ঘটনাস্থলে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এলে এক পর্যায়ে অস্ত্রধারী মাদককারবারিরা পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলের আশপাশ এলাকায় ব্যাপক তল্লাশি করে ৯টি এলজি, শটগানের ৪২ রাউন্ড তাজা কার্তুজ, ৩৩ রাউন্ড কার্তুজের খোসা এবং ১ লাখ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়, যার আনুমানিক মুল্য ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। পরে গুরুতর আহত গুলিবিদ্ধ সাইফুল করিমকে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার উন্নত চিকিৎসার জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠান। দ্রুত কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ওসি প্রদীপ আরও জানান, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত সাইফুলের বিরুদ্ধে টেকনাফ, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থানায় ৭টি মামলা রয়েছে। একইভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা দেশের মাদককারবারিদের তালিকায় এক নম্বরে রয়েছেন তিনি। সাইফুলের মৃতদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া চলছে। এ ব্যাপারে টেকনাফ থানায় পৃথক তিনটি মামলা করা হবে বলেও জানান তিনি।
জানা গেছে, চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে প্রথম দফায় ১০২ ইয়াবাকারবারি আত্মসমর্পণ করে টেকনাফে। এ সময় সাইফুল করিমের আত্মসমর্পণের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি আসেননি। দ্বিতীয় দফা আত্মসমর্পণের সুযোগকে কাজে লাগাতেই সাইফুল করিম পুলিশের সোর্সের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসছিলেন। পরে তাদের আশ্বাসে গত শনিবার ইয়াঙ্গুন থেকে বিমানযোগে ঢাকা আসেন।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পরই পুলিশের একটি টিম তাকে আটক করে কক্সবাজারে নিয়ে যায়। সেখানে নেওয়ার পর ঢাকা থেকে যাওয়া পুলিশের একটি বিশেষ টিমের কাছে ইয়াবাবাণিজ্য নিয়ে পিলে চমকানো তথ্য প্রকাশ করতে থাকেন সাইফুল। তার কাছ থেকে গত কয়েক বছর যারা নিয়মিত সুবিধা নিয়ে আসছিলেন, তাদের নাম প্রকাশ করেন। এ ছাড়া কীভাবে ইয়াবা মিয়ানমার থেকে পাচার করতেন, সারাদেশে ছড়িয়ে দিতেন, তার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেন যুবসমাজ ধ্বংসকারী এই ইয়াবা ডিলার। তার সিন্ডিকেট ছাড়া আরও যেসব সিন্ডিকেট এখনো ইয়াবার বড় বড় চালান দেশে পাচার করছে, তাদের সম্পর্কেও তথ্য প্রকাশ করেন।
র্যাব-পুলিশের হাত থেকে বাঁচতেই গত বছর সাইফুল করিম সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমারে আশ্রয় নেন। সেখান থেকেও ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন। উখিয়া-টেকনাফের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন সাইফুল করিম। সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য দুজনের সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের বিভিন্ন কারখানায় ইয়াবা তৈরির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন সাইফুল করিম। সেখান থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ পিস ইয়াবা টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পাচার করতেন। এভাবে ইয়াবাকারবার চালিয়ে সাইফুল করিম অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান। দেশ-বিদেশে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। অর্থের জোরে সিআইপি কার্ডও বাগিয়ে নেন; কিন্তু সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতেন সাইফুল করিম। টাকা দিয়ে ঘাটে ঘাটে সোর্স পালতেন। সব কিছুই অর্থের বিনিময়ে আপসরফা করতেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের পর ইয়াবার বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চালাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা যে তালিকা তৈরি করে, তাতে শীর্ষস্থানেই তার নাম ছিল। প্রায় প্রতিটি তালিকায়ই নাম ছিল সাইফুল করিমের। গত ফেব্রুয়ারিতে কক্সবাজারে ১০২ মাদক ব্যবসায়ীকে আত্মসমর্পণ করাতে যে মাধ্যমটি ভূমিকা রেখেছিল, সে মাধ্যমেই তিনি আত্মসমর্পণে আগ্রহ প্রকাশ করেন; কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। এবারের ঈদের পর ইয়াবাকারবারিদের দ্বিতীয় দফায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। আত্মসমর্পণ করার জন্যই মিয়ানমার থেকে দেশে ফেরেন সাইফুল করিম। গত বছর ইয়াবা গডফাদারদের যে তালিকা করা হয় সেখানেও এক নম্বরে রয়েছে সাইফুল করিমের নাম।
এদিকে ইয়াবা গডফাদার সাইফুল করিমের দেশে ফেরা নিয়ে গত সোমবার দৈনিক আমাদের সময়ে ‘ইয়াংগুন থেকে উড়ে এলো ইয়াবা ডন’ শিরোনামে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এর পর গতকাল শুক্রবার ‘ইয়াবা ডন সাইফুল করিমের সেফ গার্ডরা আতঙ্কে’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক আমাদের সময়।
দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, হাকিমপুর উপজেলার হিলি সীমান্তের চেংগ্রামে গত বৃহস্পতিবার রাত ২টার দিকে বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দেলোয়ার হোসেন (৪১) নামে মাদকবিক্রেতা নিহত হন। জয়পুরহাট ২০ বিজিবি ব্যাটালিয়নের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, হাকিমপুর উপজেলার মংলা বিজিবি বিশেষ ক্যাম্পে।