রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩১ অপরাহ্ন

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী হত্যা : একটি আলোচনা

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী হত্যা : একটি আলোচনা

স্বদেশ ডেস্ক:

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের চ্যাম্পিয়ন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়; কিন্তু বহু সংস্কৃতির এ দেশটি দুই দশক ধরে প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ, ঘৃণামূলক অপরাধ ও আইন প্রয়োগকারীদের বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ অসংখ্য ঘরোয়া মানবাধিকার সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। অসংখ্য পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, আগ্নেয়াস্ত্রের সাথে সম্পর্কিত সহিংসতা উদ্বেগজনক হরে বেড়েছে, যার মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও ঘৃণাপ্রসূত অপরাধের পাশাপাশি মানবাধিকারের পদ্ধতিগত লঙ্ঘনও রয়েছে। এর পাশাপাশি পুলিশি সহিংসতা মার্কিন সমাজের দৈনন্দিন সমস্যা হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে কোনো কার্যকর নীতি চালু করতে বা প্রণয়ন করতে সরকারগুলো ব্যর্থ হচ্ছে। উপরন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যার ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেয়ার বহুল আচরিত সংস্কৃতি চালু রয়েছে।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের ক্যামব্রিজে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন সে দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশী এক যুবক। ক্যামব্রিজ পুলিশ বুধবার তরুণ বাংলাদেশী-আমেরিকান ছাত্র আরিফ সাঈদ ফয়সালকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনা প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছে এবং রাজ্যের বাংলাদেশী জনগণকে ক্ষুব্ধ করেছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব নিউ ইংল্যান্ড গত বৃহস্পতিবার ক্যামব্রিজ সিটি হলের বাইরে ম্যাসাচুসেটস অ্যামহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ২০ বছর বয়সী ফয়সালের নৃশংস হত্যার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের আয়োজন করে। তারা ফয়সালের মৃত্যুকে, ‘শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারদের বর্ণবাদী কাজ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। সমিতি ফেসবুক পোস্টেও বলেছে, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিবৃতিতে বলা হয়, অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা ক্যামব্রিজের মেয়র সুম্বুল সিদ্দিকীর সাথে দেখা করে একটি ব্যাখ্যা চাইবেন। এই তরুণের মৃত্যুর জন্য অবশ্যই ন্যায়বিচার করতে হবে। পুলিশি বর্বরতার অবসান ঘটাতে হবে।

গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ফয়সালের চাচা সেলিম জাহাঙ্গীর জানান, তার জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে। তার বাবা-মা চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার বাসিন্দা। কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে সিবিএস নিউজ জানায়, ফয়সালের কাছে একটি বিশাল ছুরি ছিল। জাহাঙ্গীর দৃঢ়তার সাথে পুলিশের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয়েছে, তাদের কাছে ফয়সালের ধারালো বস্তু ব্যবহারের কোনো ভিডিও দেয়া হয়নি।
জাহাঙ্গীর বলেন, ফয়সাল ছিল শান্ত স্বভাবের ছেলে। তিনি বলেন, ‘পুলিশ কেন তাকে গুলি করেছে আমরা বুঝতে পারছি না’। তিনি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং যে পুলিশ কর্মকর্তা তাকে গুলি করেছে তার শাস্তির দাবি জানান।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুলিশের হাতে নিরস্ত্র বেসামরিক লোকদের মৃত্যুর বিষয়ে জনগণের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়েছে, যা ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, প্রাণঘাতী পুলিশ একটি বিভাজনকারী এবং চলমান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছে এবং পুলিশে সংস্কারের দাবি উঠছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন শুক্রবার বলেছেন, বিশ্বের কোথাও কোনো ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ ঘটুক বাংলাদেশ তা চায় না। তিনি বলেন, সেখানে বাংলাদেশী কমিউনিটি এটিকে ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ বলে অভিযোগ করেছে।

গত বছরের ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্পাসে এমনই রক্ত ঝরানো হয়েছিল। সালভাদর রামোস নামে এক যুবক তার ১৮তম জন্মদিনের উপহার হিসেবে পাওয়া বন্দুক দিয়ে ১৯টি শিশু এবং দুই শিক্ষককে হত্যা করেছিল। মেক্সিকো সীমান্ত থেকে এক ঘণ্টার দূরত্বে টেক্সাসের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই ঘটনা ঘটে। সীমান্ত টহল এজেন্টরা ঘটনাস্থলে এসে রামোসকে গুলি করে হত্যা করে। অর্থাৎ দেশে আরেকটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে। এ রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।

বিবিসি ও এএফপি জানিয়েছে, ওই ঘটনার কয়েক দিন আগে নিউ ইয়র্কের বাফেলোতে একটি সুপার স্টোরে গুলিতে দশজন নিহত হন। ২০১২ সালে কানেক্টিকাটের স্যান্ডি হুক এলিমেন্টারি স্কুলে বন্দুকধারীর গুলিতে ২০টি শিশু এবং আরো ছয়জন নিহত হয়। গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একই ধরনের ২৬টি ঘটনা ঘটে। ২০২০ সালে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে ওঠে বন্দুক। এটি গাড়ির দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে যায়। টেক্সাসের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গুলির ঘটনার কিছুক্ষণ পরেই, কানাডার টরন্টোতে স্কুলের আশপাশে এক বন্দুকধারীকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। এগুলি বিচারবহির্ভূত হত্যার উদাহরণ, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সংঘটিত হয়েছে। দু’টি দেশই উন্নত মানবাধিকার আইনের জন্য পরিচিত।

বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অনেক পরিসংখ্যান ব্যবহার করে এটা নিশ্চিত করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ এই বিচারবহির্ভূত হত্যার সাথে জড়িত। এই প্রেক্ষিতে আমেরিকান আইন প্রয়োগকারীদের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

তুর্কিয়ে মিডিয়া চ্যানেল আরটিওয়ার্ল্ড বিশ্বে নেতৃত্ব দানকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করেছে। ২০২০ সালের ১ জুন প্রকাশিত এক গবেষণা অনুসারে, ২০১৩ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে সাত বছরে যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে মোট সাত হাজার ৬৬৬ জন মারা গেছেন। প্রতি বছর গড়ে প্রায় এক হাজার ১০০ জন মানুষ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। গবেষণার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সালে পুলিশের গুলিতে এক হাজার ২০০ জনেরও বেশি কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। পুলিশ হেফাজতে বা অন্য কোনো কারণে মৃত্যু এই পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত নয়। দেশটিতে পুলিশের গুলিতে নিহত বা আহত হওয়ার ঘটনা শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষেত্রে অন্তত তিন গুণ বেশি।

২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটন পোস্টের এক রিপোর্ট অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা চার বছর ধরে এক হাজারের কাছাকাছি ছিল। সমীক্ষায় বলা হয় যে, ২০১৮ সালে ৯৯৬ জন, ২০১৭ সালে ৯৮৭ জন, ২০১৬ সালে ৯৬৩ জন এবং ২০১৫ সালে ৯৯৫ জন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন।

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস-এপি, ইউএসএ টুডে এবং নর্থ-ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির পণ্ডিতদের একটি দল থেকে পাওয়া রিপোর্ট অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৯ সালে যেকোনো বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গণহত্যার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে।

২০২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯৯৬টি বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটে, যার ৯৬ শতাংশই ঘটে পুলিশের গুলিতে। মানবাধিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, ৯৮.৮ শতাংশ হত্যার ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

যেকোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাই অনাকাঙ্ক্ষিত। তবু বিচারবহির্ভূত হত্যা অনেক দেশেই ঘটে। তবে সব দেশে যুক্তরাষ্ট্র একই রকম পদক্ষেপ নেয় না বা নিতে পারে না।

এটি যুক্তিযুক্ত যে, যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডার মতো দেশগুলোর এখন সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর আলোকে নিজেদের মানবাধিকার পরিস্থিতি পরীক্ষা করা উচিত। তারা যে লেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখে এখন তা পরিবর্তন করার উচিত।

সন্দেহ নেই, বিচারবহির্ভূত হত্যা মূলত ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’। এটি আন্তর্জাতিক নিয়ম ও রীতিনীতি ছাড়াও ‘ন্যায়বিচারের অধিকার’ ও উপযুক্ত আইনি প্রক্রিয়া অগ্রাহ্য করে।

এটা দেখা যাচ্ছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক আইন ও মান (স্ট্যান্ডার্ড) অমান্য করার প্রবণতা রয়েছে, যখন সেটি তার নিজ স্বার্থের অনুকূল হয়। যুক্তরাষ্ট্র যদি মানবাধিকারের প্রকৃত চ্যাম্পিয়ন হতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই তার মানবাধিকার লঙ্ঘন, পরস্পরবিরোধী নীতি এবং ‘অনৈতিক’ উপাদানগুলো পরিত্যাগ করতে হবে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877